ডলার, বিশ্বমূদ্রাব্যবস্থা এবং ইমরান খান

পাকিস্তানের আইনজীবী এবং পাকিস্তানের লাহোর হাইকোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি নাসিরা জাভেদ ইকবালের নামে একটি পোস্ট দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়াতে। তিনি নিজে অবশ্য বলেছেন এইরকম কোন পোস্ট তিনি দেন নি।

আমাদের আলোচনার জন্য অবশ্য কে লিখেছে সেটা মূল বিষয় না। পারিবারিক ভাবে নাসিরা জাভেদ আল্লামা ইকবালের পুত্রবধূ । কিন্তু পোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ। কেন ইমরান খান ক্ষমতা থেকে সম্প্রতি অপসারিত হলেন পোস্টটি তার একটি ব্যাখ্যা । যেই লিখুক যে পোস্টের আলোচনার ভিত্তিতে লিখেছি সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে সৎ থাকার জন্য সূত্র উল্লেখ করা জরুরি মনে করি।

পাকিস্তানে ক্ষমতা থেকে ইমরান খানের অপসারণ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাত দিয়ে পুরাপুরি বোঝা যাবে না। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে সেটা বোঝা যাবে না। এই যুদ্ধের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা্র পতন ঘটিয়ে বহু-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটানো।

বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে ডলার। বৈশ্বিক মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় ডলারের দ্বারা। ডলার বিশ্ব মূদ্রা ব্যবস্থার প্রধান বিনিময় মাধ্যম। তাহলে ডলার কিভাবে বিশ্বমূদ্রায় পরিণত হোল এবং তার বিরুদ্ধে এখনকার প্রধান বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব কোথায় কেন্দ্রীভূত বা আসল কিন্তু বিমূর্ত যুদ্ধক্ষেত্র ঠিক কোথায় বুঝতে হলে বিশ্বমূদ্রা হিশাবে আমাদের ডলারের একচেটিয়া আধপত্য ও নিয়ন্ত্রক ভূমিকা বুঝতে হব। নাসিরা জাভেদ ইকবালের সাম্প্রতিক লেখায় সেই সত্যটাই বেরিয়ে এসেছে।

এর ফলে পাকিস্তানের স্থানীয় দ্বন্দ্বকে বৈশ্বিক মূদ্রা ব্যবস্থার আলোকে আমাদের ভালভাবে বোঝার সুবিধা হয়েছে। প্রথাগত ভাবে আমরা যেভাবে রাজনীতি বুঝি বা বোঝার ভান করি সেটা যে কতো অন্তঃসারশূন্য এই ছোট আলোচনায় সেইসকল বকোয়াজগিরিও উদাম হয়ে যাচ্ছে।

১। পেট্রোডলার প্রসঙ্গ
‘পেট্রোডলার’ কথাটা আমরা গালি হিশাবে শুনি এবং শিখি কিন্তু মর্ম বোঝার চেষ্টা করি না। ‘পেট্রোডলার’ স্রেফ ডলারও নয় আবার দাহ্য পদার্থও নয়। পেট্রোডলার আসলে হচ্ছে বাদশা ফয়সাল এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মধ্যে ১৯৭৪ সালে করা একটি চুক্তি।

এই চুক্তি অনুযায়ী সৌদির দায়িত্ব হচ্ছে ডলারকে সার্বভৌম বিশ্বমূদ্রা হিশাবে মেনে নেওয়া। অর্থাৎ শুধু ডলার দিয়ে তেল কেনাবেচা করতে হবে, কোন দেশীয় মূদ্রা দিয়ে না। আন্তর্জাতিক ব্যবসাবাণিজ্যে ডলার ছাড়া অন্য কোন মূদ্রা যেন না চলে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডলার স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

কিন্তু ১৯৭১ সালে মার্কিন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও মূদ্রাস্ফীতি দেখ দেয়। অনেক দেশ তখন তাদের বাণিজ্যের পরবর্তে জমা ডলার ভাঙিয়ে স্বর্ণে রূপান্তর করে। তখন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন সোনার মান থেকে ডলারকে বিযুক্ত করে দিলেন। কিন্তু স্বর্ণ ও ডলারের বিযুক্তির পরও ডলার বিশ্বমূদ্রা হিশাবে টিকে রয়েছে তেলের দাম ডলারে পরিশোধ করবার চুক্তির কারণে। ডলার স্বর্ণ থেকে বিযুক্ত হয়ে যুক্ত হোল পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে।

সৌদী বাদশাহদের ক্ষমতায় থাকতে হলে একটাই কাজ: সেটা হোল ওপেকভূক্ত (Organization of the Petroleum Exporting Countries) সকল দেশকে রাজি করানো যাতে তারা ডলার ছাড়া অন্য কোন মুদ্রা বা স্বর্ণের বিনিময়ে তেল বিক্রি না করে। এর ফলে পেট্রোডলারের জন্ম হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে ডলার অনেক শক্তিশালী অবস্থানে চলে যায়। ডলার হয়ে উঠল মার্কিন টাঁকশালে ছাপা কাগজ আর পেট্রোলিয়াম মিলে এক ভুতুড়ে কারেন্সি বা আন্তর্জাতিক মূদ্রা। ডলার ও দাহ্য পদার্থের এই সম্বন্ধই ‘পেট্রোডলার’ নামে পরিচিত। এই ভুতুড়ে মুদ্রা ব্যবস্থার কারবারের ওপর বিশ্ব ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে।

.আইনজীবী নাফিস জাভেদফ ইকবাল ঠিকই বলেছেন যে এর বিনিময় আমেরিকা সৌদি বাদশাহকে গ্যারান্টি দেয় যে যতদিন তারা পেট্রোডলার চুক্তি মেনে চলবে ততদিন সৌদি পরিবার ক্ষমতায় থাকবে। এছাড়াও সৌদি মুদ্রার বিনিময় হার 1USD=3.75 SR ঠিক করে দেওয়া হয়। সৌদি অর্থনীতির যে অবস্থাতেই থাকুক আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণে এই হার উঠানামা করে না। যার ফলে তুর্কি বা পাকিস্তানের মতো সৌদি মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয় না। আমেরিকার সবসময়ই নিশ্চিত করতে চেয়েছে যেন কোনো দেশ এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে না যায়। ইরাক ও লিবিয়া বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের কী ভয়ানক দশা ঘটেছে আমরা সবই এখন জানি।

২. রুবেল-রুপি বাণিজ্য চুক্তি
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৩ সালে রুবল আর রুপি দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য করবার চুক্তি করেছে। সেটা হয়েছে ইন্দো-সোভিয়েত বাণিজ্য চুক্তির অধীনে (Indo Soviet Trade Agreement)। ভারত তার রুপি দিয়ে ভারত থেকে তেলসহ পণ্য কিনবে। এর ফলে ভারতীয় রুপির চাহিদা তৈরি হবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির মান বাড়বে। একই ভাবে রুশ রুবলও শক্তিশালী হবে। সাম্প্রতিক মার্কিন স্যাংকশানের পর ভারত তারা পুরানা চুক্তির অধীনে পরস্পরের সাথে বাণিজ্যে নিজের মুদ্রা ব্যবহার করবে। এর ফলে ডলার বা সুইট সিস্টেমের প্রয়োজন পড়ছে না। এবং চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে দুই দেশের মুদ্রাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

একই ধারণা অনুসরণ করে প্রথম কোন পাক মুখ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইমরান খান পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য নিজস্ব মুদ্রার ব্যবহারের চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে সেমিকন্ডাক্টর, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি কেনার কথা ছিল। আমেরিকা অসন্তুষ্ট হলেও চুপ ছিল কারণ এই চুক্তিতে তেল অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখানে মনে রাখতে হবে যে এই চুক্তি হয়েছে ১৯৫৩ সালে, কিন্তু পেট্রোডলার চুক্তি হয় অনেক পরে, ১৯৭৪ সালে।

৩। ইমরান খান প্রসঙ্গ
মুদ্রা ব্যবস্থার এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে আমরা পাকিস্তানের রাজনীতি আরও ভালভাবে বুঝতে পারব। বিশ্ব ব্যবস্থায় যে মার্কিন আধিপত্য বলয় যাঁতাকলের মতো চেপে বসে আছে সেই বৃত্ত থেকে তার বেরিয়ে আসার চেষ্টা রয়েছে। এটা তাঁর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সন্দেহ নাই। পাকিস্তানের জন্যও বটে। কিন্তু তাঁর এই রাজনীতি পাকিস্তানের জনগণের মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। এর আগে তিনি পরিষ্কার এটা ব্যক্ত করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা মতো ওঠবস করবার দিন শেষ হয়ে গিয়েছে।

দাসত্বের অবসান হওয়া উচিত। একটি জনগোষ্ঠিকে তাদের আত্মমর্যাদা বোধের ওপর দাঁড়াতে হবে। মার্কিন আধিপত্যবলয় থেকে বেরিয়ে এসে সাহসী হয়ে ২০২২ সালে ইমরান খান রাশিয়া থেকে রুবল ও পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার করে তেল কিনার আলোচনা শুরু করেন। আমেরিকার চরমভাবে ক্ষিপ্ত হবার এটাই আসল রহস্য। কারণ ইমরানের উদাহরণ অনুসরণ করে সবাই যদি ডলার ছাড়াই তেল কেনা বা বাণিজ্য করা শুরু করে তবে ডলার তার বর্তমান বৈশ্বিক দাপট হারাবে এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন আধিপত্যও নড়বড়ে হয়ে যাবে। এতে সুপার পাওয়ার’ হিসেবে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হতে শুরু করবে।

ইমরান ছিলেন প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী যিনি ২০১৯ সালে পাকিস্তানি রুপি-চীনা ইউয়ান চুক্তি করেছিলেন। এই চুক্তির মধ্যে ছিল সেমিকন্ডাক্টর, ট্রান্সফরমার, সম্প্রচার সরঞ্জাম, ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে অবশ্যই নাখোশ হয়েছিল। কিনতি একে বাধা দেয় নি, কারন এই চুক্তির মধ্যে তেল অন্তর্ভূক্ত ছিল না। এটি যেতে দিন কারণ এটি তেল অন্তর্ভুক্ত করেনি। তেলের জন্য পাকিস্তানি রুপি-রাশিয়া রুবেল চুক্তি করার প্রক্রিয়া ঘটছে ২০২২ সালে। মনে রাকগতে হবে পেট্রোডলার চুক্তিটি ১৯৭৪ সালের।

ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই এই চুক্তি হতে দিতে পারে না। কারণ অন্যান্য দেশ ইমরানকে অনুসরণ করলে মার্কিন ডলার দুর্বল হবে এবং ‘পেট্রো-ডলারের জারিজুরি মুখ থুবড়ে পড়বে। মার্কিন অর্থনীতি দুর্বল হবে। সুপার পাওয়ার হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয় হচ্ছে। যদি এই চুক্তি হয়ে যেত তাহলে পাকিস্তান মার্কিন দাসত্বের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসত। সেই জন্যই তাকে তড়িঘড়ি অপসারণ করতে হয়েছে।

#ইউক্রেন , #Pakistan , #PTI , #ImranKhan

লেখকঃ ফরহাদ মজহার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *