পুঁজিবাজার এমন বেহাল কেন?

দেশের বর্তমান অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের আলোচনা-সমালোচনা বেশ জমে উঠেছে। আর সেসব ক্ষেত্রে সরকারি আমলারাও পিছিয়ে নেই।

এ বিষয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও তাদের সরব হতে দেখা গেছে। ইদানীং একটি অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অনেককেই বলতে শোনা গেল, দেশের অর্থনীতি কখনো শ্রীলংকার মতো হবে না।

কারণ, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ভিত অনেক মজবুত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও প্রচুর। তাদের এসব কথাবার্তা শুনে ভালোই লাগল। কারণ, আমি বা আমরা সবাই চাই, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যেন শীলংকার মতো না হয়। কিন্তু তারা যখন এমন আশাবাদের কথা শোনাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেশের পুঁজিবাজার বেহাল দেখে মানুষ প্রমাদ গুনছেন।

গরিষ্ঠসংখ্যক দেশের মানুষের নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থায় তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে; অথচ মাথাপিছু আয়ের সরকারি হিসাব অনুযায়ী এমনটি হওয়ার কথা নয়। আবার পুঁজিবাজারকে একটি দেশের অর্থনীতির ব্যারোমিটার হিসাবে গণ্য করলে এত ভালো ও শক্ত ভিত্তির অর্থনীতির দেশের পুঁজিবাজার এমন বেহাল হওয়ারও কথা নয়! কারণ, যেসব অর্থনীতিবিদ দেশের অর্থনীতিকে শ্রীলংকার সঙ্গে তুলনা করা গর্হিত কাজ বলেছেন, পুঁজিবাজারও তারাই পরিচালনা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় শিক্ষকসহ অর্থনীতির বড় বড় পণ্ডিতদের বিএসইসি, ডিএসসি, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভৃতি স্থানে বসানো হয়েছে, যিনি বা যারাই মূলত পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। আর দেশের অর্থনীতির নেতৃস্থানীয় এসব ব্যক্তি মাঝেমধ্যেই পুঁজিবাজার নিয়ে দেশে বিদেশে ‘রোড শো’ করে মানুষকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহও জোগান। আর সেই পুঁজিবাজারই যখন বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে, তখন দেশের অর্থনীতির এসব পণ্ডিতের ওপর দেশের মানুষের ভরসাই বা কতটুকু?

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রীলংকার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের দেশের অর্থনীতি শ্রীলংকার মতো হবে বা হোক, আমরা কেউ তা চাই না। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাটিও সত্যি যে, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে যারা কাজ করে চলেছেন; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কথার সঙ্গে কাজের বা বাস্তব ঘটনার কোনো মিল নেই। তাছাড়া নিজ নিজ চেয়ার রক্ষার খাতিরে মাঝেমধ্যে তারা ফরমায়েশি কথাও বলে থাকেন।

দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, সরকারি কোষাগারের স্ফীত অবস্থা ইত্যাদি বিষয় তারা যেভাবে তুলে ধরেন, ঠিক সেভাবে দেশের মানুষের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কত, সে সম্পর্কে তারা তেমন কিছু বলেন না। অথচ দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণও কিন্তু কম নয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিজন বাংলাদেশি নাগরিকের মাথায় ৬৬২ ডলার ঋণের বোঝা চেপে আছে।

আর সেসব বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে বাংলাদেশ যেমন এগিয়ে চলেছে, সেই চলার পথে অনেক ঝক্কি ঝামেলাও আছে। সুতরাং, সামনের দিকে আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে কোনো ঝুঁকি নেই, বুকে হাত দিয়ে তা কেউ বলতে পারবেন না বা বলা উচিতও হবে না। কারণ, আমাদের অর্থনীতির কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে, যার অন্যতম হলো অর্থপাচার। যেভাবে এদেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সে চিত্রটিও অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকার স্বীকার করুক আর না করুক, অর্থ পাচার রোধে সরকার বা সরকারি সংস্থাগুলো অনেকটাই ব্যর্থ।

কারণ, একশ্রেণির লুটেরা চক্র নিত্যনতুন পদ্ধতিতে টাকা পাচার করে চলেছে। রাজনীতি থেকে টেন্ডারবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে লুটে নেওয়া একটি টাকাও এদেশে নেই বা রাখা হয় না। কারণ, সেসব টাকা দেশে রাখলে লুটেরা চক্র ধরা খেয়ে যাবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনেক শিল্পপতি ব্যবসায়ীও ওভার ইনভয়েসিং আন্ডারইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করে থাকেন। কেউ কেউ আবার তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার নামে বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে সেখানে তাদের নামে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন!

এভাবে তারা তাদের সন্তান এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন! ফলস্বরূপ নির্ধারিত কর প্রদানের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও কালো টাকার মালিকরা সে পথে পা বাড়ান না। তখন ভাবসাব দেখে মনে হয়, দেশে যেন কালোটাকাও নেই, কালোটাকার মালিকও নেই! আর তার কারণ একটাই; দেশ থেকে অবাধে অর্থ পাচারের সুযোগ।

বস্তুত বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পন্থায়, অতি সহজেই এখন বিদেশে টাকা পাঠানো হয়; যার অন্যতম পদ্ধতি হলো ‘হুন্ডি’! হুন্ডির মাধ্যমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করা হয়ে থাকে। বর্তমান অবস্থায় প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক লোক ভারতের ভিসার লাইনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের অনেকের চিকিৎসা বা ভ্রমণের উদ্দেশ্য থাকলেও অনেকেই আবার মুদ্রা পাচার, হুন্ডি ইত্যাদি কারণে ভারত গমন করে থাকেন।

আর এ বিষয়ে আমার চাক্ষুস প্রমাণ আছে। প্রায় বছর তিনেক আগে একবার আমি ভারতের একটি হোটেলে চেক ইন-এর সময় রিসেপশনে বসে থাকা অবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে আমার পাশে বসা অন্য একজন ব্যক্তির হাতে পাঁচ লাখ ভারতীয় মুদ্রা গুনে তুলে দিলেন। অতঃপর টাকা নিয়ে সে ব্যক্তি চলে গেলে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো আগত ব্যক্তি আমার দিকে তাকিয়ে আমাদের দেশি উচ্চারণে আমি বাংলাদেশি কি না জিজ্ঞাসা করায়, আমি হ্যাঁ বলায়, তিনি বললেন, তার বাড়িও বাংলাদেশের ময়মনসিংহে।

আমি অবাক হয়ে টাকা লেনদেনের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, হুন্ডির টাকা এবং তিনি হলেন বাংলাদেশে অবস্থানরত একজন মাড়োয়ারি হুন্ডি ব্যবসায়ীর কর্মচারী। প্রতি ছয় মাস পর পর তিনি দেশে যান এবং কিছুদিন পর এ কাজে আবার ভারতে আসেন। ভিসাসহ তার আসা যাওয়ার সব ব্যবস্থা বাংলাদেশে অবস্থানরত মাড়োয়ারিই করে দেন! তারপর সেই ব্যক্তি বাংলাদেশে ফোন করে হিন্দি ভাষায় টাকা প্রদানের খবরটি তার বসকে প্রদান করে স্থান ত্যাগ করলে সেদিন আমি এসব নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম।

আর এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমাদের দিন চলে যাবে; যেমন স্বাধীনতার পর ৫১ বছর পার হয়ে গেল অথচ মুদ্রা পাচার, সোনাদানা পাচার ইত্যাদি অপকর্ম সমানতালে চলল। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এসব অপকর্ম যে বহুলাংশে বেড়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। আর এজন্য আমাদের চিকিৎসা ও ট্যুরিজম ক্ষেত্রের চরম দুরাবস্থাও দায়ী। স্থানাভাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত না বলে সরকারের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলেই লেখাটি শেষ করব; তা হলো, সরকারের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদের প্রতি একটি আবেদন।

আর সে আবেদনটি হলো-‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশ এবং দেশের মানুষকে ধন্য করেছেন। এখন কক্সবাজারে দুটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল এবং দু-একটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ করা গেলে দেশের মানুষকে দেশে আটকানো সম্ভব হবে বলে মনে করছি। আপনি ইচ্ছা করলে এ কাজে সহজেই বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া যাবে।’ আশা করি, আমার মতো প্রবীণ ব্যক্তির এ কথাটি কেউ না কেউ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কানে তুলবেন। কারণ, আমি মনে করি, এতে করে কিছুটা হলেও দেশের টাকা দেশে থেকে যাবে।

সবশেষে, দেশের সম্মানিত অর্থনীতিবিদ, বিশেষ করে যারা পুঁজিবাজার চালাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশে বলব-এ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে আপনাদের মুখের দিকে চেয়ে আছেন; যাদের মধ্যে নারী বিনিয়োগকারীসহ অনেক শিক্ষিত বেকারও আছেন। এ অবস্থায় বারবার তাদের বিনিয়োগের টাকাগুলো গিলে খাবার সুযোগ করে দেবেন না।

একেক ধাক্কায় পুঁজিবাজার থেকে দশ-বিশ হাজার কোটি টাকা লোপাট হবে, গায়েব হবে; আর বড় বড় চেয়ারে বসে হিসাব কষে দেখবেন, গত এক মাসে বিশ হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজার মূলধন হারিয়েছে; নিশ্চয়ই সরকার এজন্য আপনাদের বড় বড় চেয়ারে বসাননি! অর্থনীতি নিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন, গলাবাজি করেন, তাদের উদ্দেশ্যেও বলব-দেশের অর্থনীতি এতটা ভালো হলে পুঁজিবাজার এমন বেহাল কেন?

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *