বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে ভারত?

বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেবল ভারতের সহযোগিতাই চায়নি, ‘এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়রাও (নন–রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান,

এনআরআই) মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছে’ (প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০২২)। এ খবর কেবল নানা প্রশ্নেরই জন্ম দেয় না, উদ্বেগেরও সৃষ্টি করে। একে কূটনৈতিক কার্যকলাপ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই, বরং এটা র‍্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতারই প্রমাণ।

গত ১০ ডিসেম্বর র‍্যাব এবং র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে ডেকে তার আপত্তি প্রকাশ করেছিল।

বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সঠিক মনে করেনি বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে গত ১৬ ডিসেম্বর আলাপকালে বাংলাদেশের এ আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন।

গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে ব্লিঙ্কেনকে যে চিঠি দেন মোমেন, সেখানেও র‍্যাবের প্রশংসা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি কেন ভালো, এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

প্রাথমিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পর বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই নমনীয় হয়ে আসে। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, ‘ভিত্তিহীন এবং বানানো তথ্যের’ ভিত্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

সরকার ও সরকারের সমর্থকেরা এ কথা মানতে রাজি ছিলেন না যে হঠাৎ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়। ২০২০ সালেই কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সদস্যরা পররাষ্ট্র দপ্তরকে এ ধরনের অনুরোধ করেছিলেন।

সরকারের কথিত ভুল তথ্য কে বা কারা সরবরাহ করেছেন, সে বিষয়েও সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, দলটি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে এ ব্যবস্থা করেছে।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারও লবিস্ট নিয়োগ করে, তবে সরকারের দাবি, তারা লবিস্ট নয়, জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বা পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে (প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০২২)। এসব না করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পরামর্শ কোনো কোনো মহল থেকে এলেও সরকার তা বিবেচনায় নেয়নি।

স্মরণ করা যাতে পারে, সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র‍্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে।’ এখন ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হওয়ার পরে প্রশ্ন ওঠে, এ সময় কি শেষ হয়ে গেছে?

গত মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিকবার সরাসরি আলোচনা হয়েছে। মার্চ মাসে পার্টনারশিপ ডায়ালগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ঢাকায় গেলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তখন নুল্যান্ড বলেছিলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জটিল বিষয়।’ ওই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিকল্পনার কথা জানানো হয়, সেখানে বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নেবে, তার উল্লেখ ছিল। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নিরাপত্তা সংলাপেও র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, ‘র‍্যাব সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা, মাদক-মানব পাচার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভাষায়, ‘র‍্যাব আস্থার প্রতীক’; পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ভাষায়, র‍্যাব হচ্ছে ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন ন্যায়বিচারের প্রতীক হবে, সেটা বোধগম্য নয়। বিচার করার দায়িত্ব কীভাবে র‍্যাবের হাতে অর্পিত হয়েছে, সে প্রশ্ন আপাতত বাদ দিলেও যে প্রশ্ন বাদ দেওয়া যাচ্ছে না, তা হচ্ছে যে বাহিনী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত, তার ব্যাপারে অভিযোগ খণ্ডনে তৃতীয় একটি দেশের সাহায্য চাওয়ার দরকার হলো কেন, কী বিবেচনায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হলো?

এটাও মনে রাখা দরকার, শুধু র‍্যাবের আচরণ নিয়ন্ত্রণই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে তা নয়, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দরকার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। সরকারের করণীয় হচ্ছে সেই লক্ষ্যে কাজ করা, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। এ জন্য তৃতীয় দেশের সাহায্যের দরকার নেই। জাতীয় স্বার্থের দেখভাল করার দায়িত্ব অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য মর্যাদাকর নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও ইতিবাচক নয়।

বাংলাদেশ কেন ভারতের মুখাপেক্ষী হয়েছে, সেটা দুর্বোধ্য নয়। প্রথমত, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সখ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা। ক্ষমতাসীনদের ভারতনির্ভরতা সুবিদিত। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা এতটাই প্রবল যে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে কেবল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরাই নন, এমনকি বিএনপির নেতারাও নয়াদিল্লির দ্বারস্থ হয়েছিলেন।

ফলে ভারতের সাহায্য চাওয়া বিস্ময়কর নয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটন দিল্লির চোখে এ অঞ্চলের ছোট দেশগুলোকে দেখে এসেছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, নয়াদিল্লির তদবিরে কাজ হবে। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন সেই মাত্রায় আছে কি না, সে বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সাল থেকেই আলাদাভাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে আয়োজিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিবিষয়ক এক ভার্চ্যুয়াল ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি লরা স্টোন বলেছিলেন, ‘দিল্লির চোখে বাংলাদেশকে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র’ (মানবজমিন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০)। কিন্তু এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা যদি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তবে বাংলাদেশের স্বার্থে ভারত কেন প্রতিনিধিত্ব করবে?

ভারত বা তৃতীয় পক্ষ কেবল তখনই সুপারিশ করবে, যখন তার স্বার্থ জড়িত থাকবে। এখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব যদি ‘আউটসোর্সিংয়ের’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। বাংলাদেশের সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রায়ই উদ্বেগ-আশঙ্কা প্রকাশ করে। ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করলে শাস্তি পাওয়ার আইন রয়েছে। এ সিদ্ধান্তে কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করবে না?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়রাও মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছেন।’ মার্কিন সরকারকে যেকোনো বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠন অনুরোধ করতেই পারে। কিন্তু এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়; প্রথমত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় মনে হয় যে সরকারের জ্ঞাতসারেই তা করা হয়েছে।

সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের কি সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল? সেই অনুরোধ কি কোনো সংগঠনকে করা হয়েছে? দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি-আমেরিকান থাকার পরেও এ অনুরোধ ভারতের নাগরিকদের কাছ থেকেই আসতে হলো কেন?

র‍্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের যে উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ কোনটা, সেটাই আগে বোঝা দরকার, ঠিক করা দরকার। এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যা বলেছেন, তা স্মরণ করা যায়, ‘র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ রয়েছে, তার সুরাহার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই’ (প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল ২০২২)।

এটাও মনে রাখা দরকার, শুধু র‍্যাবের আচরণ নিয়ন্ত্রণই দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে তা নয়, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দরকার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। সরকারের করণীয় হচ্ছে সেই লক্ষ্যে কাজ করা, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। এ জন্য তৃতীয় দেশের সাহায্যের দরকার নেই। জাতীয় স্বার্থের দেখভাল করার দায়িত্ব অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য মর্যাদাকর নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও ইতিবাচক নয়।

● আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

উৎসঃ প্রথমআলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *