সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করতে পারবে জনগণ!

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ বা আদেশে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের ক্ষতিপূরণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে দায়বদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাদের পক্ষে যেকোনো ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করতে পারবে।

ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত এক মামলার রায়ে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হাইকোর্ট। ‘মো. জহিরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য’ শিরোনামে মামলাটির ৫৩ পৃষ্ঠার রায় সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃত ১৮ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়ে গত বছরের ৩০ জুন এ রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

মামলার পূর্বাপর

২০১৭ সালের এপ্রিলে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে প্রায় ৩৫০ জন যাত্রী নিয়ে একটি সি-ট্রাক সন্দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেয়। সন্ধ্যায় জাহাজটি সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটের কাছে পৌঁছায়। জাহাজটি সরাসরি ঘাটে ভিড়তে না পারায় সেটি ঘাটের কিছুটা দূরে থামিয়ে যাত্রীদের নৌকায় করে ঘাটে নেওয়া হচ্ছিল।

এ রকম একটি নৌকা যাত্রী নিয়ে ঘাটে যাওয়ার সময় ঢেউ ও বাতাসে উল্টে যায়। পরে কোস্ট গার্ড ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ২২ জনকে জীবিত ও ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত ১৮ জনের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১৯ সালে রিট আবেদন করেন সন্দ্বীপের বাসিন্দা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত নিহতদের ক্ষতিপূরণ রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি শেষে তা যথাযথ ঘোষণা করে ৯টি নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট।

১৮ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ

সন্দ্বীপের সে সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. গোলাম জাকারিয়ার দেওয়া নিহত ১৮ ব্যক্তির তালিকা উল্লেখ করে আদালত রায়ে বলেছেন, এই ১৮ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ হরণ করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডাব্লিটিসি) ও চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের (সিডিসি) অবহেলার কারণেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। যে কারণে রুলটি চূড়ান্ত করা হলো।

রায়ে আদালত ১৮ নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিআইডাব্লিউটিসি ও সিডিসিকে সমান হারে চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকের মাধ্যমে এই টাকা দিতে নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছেন, ‘ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এই রিট মামলাটি যেদিন করা হয়েছে, সেদিন থেকে ক্ষতিপূরণের মোট টাকা অর্থাৎ দুই কোটি ৭০ লাখ টাকায় ৮ শতাংশ হারে সুদও দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে। ’

প্রতিকার হিসেবে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াই উৎকৃষ্ট

১৯৯৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ‘ডি ডি বসু বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ রায়ের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে এ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কারণে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হলে টর্ট আইনে (পূরণযোগ্য ক্ষতি আইন) ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ ব্যক্তির ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাবলিক আইনের পাশাপাশি প্রাইভেট আইনেও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। আদালত বলেন, আদালত তার বাস্তব জ্ঞান ও সচেতনতার চোখ বন্ধ রাখতে পারে না। অপরাধীর শাস্তি ভুক্তভোগী তথা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারকে উল্লেখ করার মতো কোনো সান্ত্বনা দেয় না। প্রতিকার হিসেবে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াই উত্কৃষ্ট এবং একমাত্র প্রতিবিধান, যা ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের ক্ষতে মলম লাগানোর মতো।

উৎসঃ কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *