মাহবুব তালুকদার, ক্ষমা করবেন আমাদের!
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জানাজা শেষে মাহবুব তালুকদার (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ – ২৪ আগস্ট ২০২২) চিরনিদ্রায় শায়িত কবরগাহে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার যে ধ্বনি তিনি উচ্চকিত করেছিলেন প্রতিবাদ, ভিন্নমত ও বিতর্কের শাণিত ভাষায়, তা নিশ্চয় মাটিচাপা পড়ে হারিয়ে যাবে না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংগ্রামশীল অভিযাত্রার সমান্তরালে তার কথাগুলো প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত্ব হতে থাকবে।
একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন লেখক, নৈর্ব্যক্তিক প্রশাসকের বহুমাত্রিক পরিচিতির বর্ণময়তায় উজ্জ্বল মাহবুব তালুকদার, জীবনের পরিসমাপ্তিকালে নিজেকে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রতীকে উৎকীর্ণ করেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের এমনই এক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়ে যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি ও প্রত্যাশাই প্রধানতম প্রসঙ্গ।
ভিন্নমত, বিতর্ক ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ, সার্বজনীন অংশগ্রহণ এবং গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করার পথসন্ধান করেছিলেন তিনি। যে পথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতা এবং বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামশীল ঐতিহ্যের গৌরব ও অর্জনের অবিচ্ছেদ অংশ।
মাহবুব তালুকদার তার মতামত ও সিদ্ধান্ত নিজস্ব অবস্থানের মধ্যে থেকেও জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দ্বিধাহীন ভাবে প্রকাশ করেছেন। জীবনের পরোয়া না করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ছুটে গেছেন। ১৫ আগস্ট–পূর্ববর্তী পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন অকপট সত্যের অক্ষরে: “বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করতে সমবেত হলো আবালবৃদ্ধবনিতা, রাজনীতিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, কৃষক-শ্রমিকসহ সকল পেশাজীবী মানুষ।
তারা মিছিল করে, নৃত্য করে, বাদ্য বাজিয়ে, উল্লাস করে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা ৩৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। অনেকেই নতুন সরকারের সঙ্গলাভে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।” এহেন সত্যভাষণের জন্য মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার কয়েক দিন পর মাহবুব তালুকদার ওএসডি হন।
ওএসডি শাস্তিরই অংশ।
তারও আগে মাহবুব তালুকদার বঙ্গভবনে তার কাজের অভিজ্ঞতা বয়ান করেছেন ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ বইয়ে। এটি একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণামূলক বই। এতে ক্ষমতার অন্দরমহলের অনেক অজানা ঘটনার পাশাপাশি সেই সময়ের ক্ষমতালিপ্সু ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক, সামরিক–বেসামরিক আমলাদের চরিত্রও উন্মোচিত হয়েছে। আমলাতন্ত্র ভেতরে থেকে তার মতো আর কেউ সমালোচনামূলক কোনো লেখা বা বক্তব্য দেন নি। তিন দশক আমলাতন্ত্রের ভেতর থাকলেও তিনি পুরোপুরি ‘আমলা’ হতে পারেননি। বহিরাগত থেকে গেছেন, যার অম্ল-মধুর বিবরণ আছে তার লেখা ‘আমলার আমলনামা’ গ্রন্থে।
আমলাদের অনেকই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখেছেন চাকরিক্ষেত্রে এবং চাকরি শেষে পছন্দের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে আখের গুছিয়েছেন। কিন্তু মাহবুব তালুকদার কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করেন নি। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন থেকে নিজের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন এবং এজন্য পেশাজীবনের নানা পর্যায়ে বিরূপতা ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
শেষজীবনে নির্বাচন কমিশনার পদে আসীন হয়েও সত্যনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী বক্তব্যের কারণে তিনি কোনো দলের প্রিয়পাত্র হওয়ার বদলে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। ২০১৭-২০২২ মেয়াদে কেএম নুরুল হুদার কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব তালুদকার। তিনি কমিশনের নীতি ও কাজের সমালোচনা করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন বারবার।
জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আরও বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করতে পারেন-এমন আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। এ কারণে তার ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল নেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোট মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগের দাবিও তুলেছিল।।
তথাপি হতোদ্যম হন নি মাহবুব তালুকদার। কমিশনারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় বলে একা মাহবুব তালুকদার খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি। তবু তিনি গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরায় মানুষ অনেক কিছু জানতে পেরেছে। গণতন্ত্রে যে ভিন্নমত ও বহুমতের সম্মানজনক জায়গা আছে, তিনি সেটা সমুন্নত রাখতে লড়েছেন। তার অবস্থান মহল বিশেষের পছন্দ না হলেও তিনি ছিলেন ‘বিউটি অব ডেমোক্রেসি’র অনুসারী ও উপাসক। সকলের অংশগ্রহণ ও বক্তব্য না থাকলে তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্র একদলীয় ও স্বেচ্ছাচারী হতে পারে, এ কথার প্রতিফলন করতে চেয়েছিলেন প্রতিবাদ ও ভিন্নমতের মাধ্যমে।
অতীতের অনেক নির্বাচনে, এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন তথা ইসিকে নিয়ে ভাবতে হয়নি সংশ্লিষ্টদের। অতীতে কোনো ইসির কোনো কমিশনার নিজের অবস্থান ও বক্তব্যের মাধ্যমে বেকায়দায় ফেলে বিরাগভাজন হন নি। বরং অনুগত থেকে বাহবা কুড়িয়েছেন। মাহবুব তালুকদার ছিলেন এমন একজন কমিশনার, যাকে নিয়ে কিছুটা ‘ঝামেলা’য় পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনার সংবাদমাধ্যমের কাছে এমনও বলেছিলেন যে, মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য কমিশনের বৈঠকের বাইরে আসায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সমালোচিত হচ্ছে।
কি চেয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার, যেজন্য তার মতো একজন একাকী-ভিন্নমত পোষণকারীকে নিয়ে এতে কথা হয়েছে? মাহবুব তালুকদার বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেছিলেন। তিনি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সংলাপ থেকে আসা সুপারিশগুলোর আলোকে পাঁচ দফা প্রস্তাব তৈরি করেছিলেন। তিনি এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য কমিশনারদের আপত্তির কারণে তা তুলতে পারেননি। পরে তিনি আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়ে সভা বর্জন করে সাংবাদিকদের কাছে প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন।
কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের মতবিরোধ প্রথম ও একমাত্র ছিল না। নীতি নির্ধারণী বিষয়ে আরো মতবিরোধ সামনে এসেছে। মূলত কারো বা কোনো পক্ষের চাওয়া পূরণের পথে ইসির পদক্ষেপে আপত্তি তুলেছিলেন মাহবুব তালুকদার।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দাবি জানিয়েছিল, সিটি নির্বাচনে সাংসদের প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। এরপর তড়িঘড়ি করে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয় ইসি। তখন কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার।
জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার পক্ষে আওয়ামী লীগ। ইসির সংলাপে তারা এই মত জানিয়েছিল। বিপরীতে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল এর বিপক্ষে। এই প্রেক্ষাপটে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পথ সুগম করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগেরও আপত্তি জানান মাহবুব তালুকদার। যেদিন আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব ইসি অনুমোদন করেছিল, সেদিনও মাহবুব তালুকদার ভিন্নমত দিয়ে সভা বর্জন করেছিলেন।
অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে পাঁচটি ‘নি’ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নতুন যোগ দেওয়া ৪৯ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার ১২ দিনব্যাপী এক কর্মশালায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাহবুব তালুকদার তার পাঁচ ‘নি’ উপস্থাপন করেন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, প্রথম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিশ্চয়তা’—এটা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা। এ নিশ্চয়তার অর্থ ভোটার ও রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টি। দ্বিতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরপেক্ষতা’—নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি। কমিশনের পক্ষে এই নিরপেক্ষতা অপরিহার্য। তৃতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরাপত্তা’-এই নিরাপত্তা ভোটার, রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকরভাবে নির্বাচনকালে কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা দরকার। চতুর্থ ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়ম-নীতি’-নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে বিধিবিধান পরিচালনের আওতায় আনা প্রয়োজন। পঞ্চম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়ন্ত্রণ’-নির্বাচন অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। স্বনিয়ন্ত্রণই নির্বাচন কমিশনের মূল কথা।
মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, কমিশনের অনেক অর্জন আছে। বিসর্জনও আছে। তিনি কোনো মূল্যায়ন করতে যান নি। তবে আগামীতে যাতে কমিশনের অর্জনের পাল্লা ভারী হয়, সেটাই ছিল তার ঘোষিত ও প্রকাশ্য প্রত্যাশা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, “সংবিধান বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে যে অপরিমেয় ক্ষমতা দিয়েছে, পৃথিবীর খুব কম দেশের কমিশন এমন ক্ষমতায় অধিকারী। এমনকি ভারতের কমিশনও এত ক্ষমতার অধিকারী নয়।” তবে, “ক্ষমতা থাকলেই কেবল হবে না। ক্ষমতার প্রয়োগ না হলে সে ক্ষমতা অর্থহীন। কমিশন তার ক্ষমতার কতটুকু প্রয়োগ করতে পেরেছে, তা সময়ই বিচার করতে পারবে।”
গণতন্ত্র-নির্বাচন অভিন্ন সূত্রে বাঁধা উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার মনে করতেন, “আমরা কোনো অবস্থাতেই মানুষের ভোটাধিকার লঙ্ঘিত ও ভূলুণ্ঠিত হতে দিতে পারি না। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নিশ্চয়তা, নিরপেক্ষতা, নিরাপত্তা, নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণ কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।”
মাহবুব তালুকদার একাধিক বার বলেছেন, “গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য আমার কোনো অবস্থাতেই মানুষের ভোটাধিকারকে লঙ্ঘিত ও ভূলুণ্ঠিত হতে দিতে পারি না।” লেখক ছিলেন বলেই মাহবুব তালুকদার সব সময় স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। লড়েছেন। ব্যর্থ হবেন জেনেও প্রতিবাদ করেছেন। প্রায়ই তিনি বলছেন, “আমি তো চেষ্টা করেছি। ওদের চরিত্র উন্মোচন করছি। এর চেয়ে বেশি কী করতে পারি?”
তিনি যতটুকু করেছেন, তাতেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছিলেন ‘বিবেকের কণ্ঠস্বরে’। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন ব্যবস্থার অংশ হয়েও তিনি প্রায়শ ‘সত্যের প্রতিধ্বনিতে’ পরিণত হয়েছিলেন। সাদাকে সাদা বলার সৎ সাহসে তিনি যেসব উক্তি করেছেন, তা শুধু সাহসী ও দল নিরপেক্ষই ছিল না, ছিল ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যবাহী। ভবিষ্যতের গবেষকরা তার বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রকৃত ক্ষত ও রূপচরিত্রের সন্ধান পাবেন এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভালোমন্দের যথার্থ অবয়বটি দেখতে পাবেন।
নিশ্চিতভাবে তার কথাবার্তা অনেককেই অখুশি ও বিব্রত করেছে। তিনি অনেকের বিরাগভাজননও বিরক্তির কারণ হয়েছেন। কিন্তু তার কথাগুলোকে অসত্য বা অগ্রহণযোগ্য বলতে পারেন নি কেউই। খুব বেশি না হলেও সমাজে এমন চরিত্র থাকতে হয়। যারা সবকিছুর পরেও বিবেকের কাছে ও নিজের স্বাধীন বিচার-বিবেচনার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।
অবসর জীবনে এক প্রকার আকস্মিকভাবেই তিনি যখন লাইমলাইটে আসেন নির্বাচন কমিশনার পদে মনোনীত হওয়ার মাধ্যমে, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি ‘এই’ দলের বা ‘ঐ’ দলের। কিন্তু প্রবলভাবে দল-প্রভাবিত পরিস্থিতিতে সবাইকে চরম বিস্মিত করে কোনো দলের লোকই হন নি তিনি। বরং তিনি দলীয় পদলেহন ও আনুগত্যের ধারেকাছে না গিয়ে নিজের আলাদা ও একাকী অবস্থান গ্রহণ করে তৈরি করেন নিজের ‘ওয়ানম্যান আর্মি’।
তিনি ছিলেন তার প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু, একাকী ও নিঃসঙ্গ। কিন্তু তার সংখ্যালঘিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সংখ্যাগুরুদের বিব্রত ও জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল এবং তার বক্তব্য ও অবস্থান স্পর্শ করেছিল জনতার এক বৃহত্তম অংশকে। গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে তার মতামত অনেকের গাত্রদাহের কারণ হলেও মানুষের কাছে মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। হয়ে উঠেছিল সত্যের সংলাপ।
নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১২০০ পৃষ্ঠার বই লিখেন তিনি ‘নির্বাচননামা’ নামে। তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, জীবদ্দশায় বইটি প্রকাশ করা ঠিক হবে কি না। আর ছিল প্রচণ্ড দুঃখবোধ। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারার যে বেদনা নিয়ে তিনি তার দায়িত্বকাল শেষ করেছিলেন, সেই বেদনার আবহেই তিনি জীবনের কাছ থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও অবাধ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন যুগসন্ধিক্ষণের এক অনন্য চরিত্র রূপে।
তিনি নাটকের বিবেক ছিলেন না। কিংবা পৌরাণিক নারদ চরিত্র হয়ে শুধু উপদেশ বিতরণকারীও ছিলেন না। তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন: গণতন্ত্রের পক্ষে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। নিজের উপর অর্পিত কাজ নানা বিরোধিতা ও অসহযোগিতায় করতে পারেন নি তিনি। কিন্তু অশীতিপর, অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি ব্যর্থতায় স্থবির, নির্বাক ও ন্যূব্জ হন নি। তিনি হয়ে ওঠেন এক আপাদমস্তক প্রতিবাদী মানুষে। তবে, এটাও ঠিক যে, তিনি বিপ্লবী ছিলেন না। সাংবিধানিক সীমারেখা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বিপ্লব করার এবং বৈপ্লবিক হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। তথাপি তিনি তার সীমিত সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং একচ্ছত্র একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে।
মেরুদণ্ডওয়ালা একজন মাহবুব তালুকদার, ক্ষমা করবেন আমাদের, এইজন্য যে, ‘বর্তমান’ আপনার কথা গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু ‘ভবিষ্যত’ এসবের অন্তর্নিহিত মর্ম উপলব্ধি করবে গণতন্ত্র ও অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, লেখক-রাজনীতি বিশ্লেষক।