তৃণমূলে সংঘাত, বিএনপি’র কর্মসূচিতে টানা হামলা
হঠাৎই সংঘাতমুখর হয়ে উঠেছে তৃণমূল রাজনীতি। বিএনপি’র বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশের মতো মামুলি কর্মসূচিতে হামলা হচ্ছে টানা। দলটির নেতাকর্মীদের অনেকের বাড়ি-ঘরেও হামলা হচ্ছে। যশোরে সিরিজ হামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে।
এসব হামলার জন্য আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দায়ী করছে বিএনপি। কোথাও কোথাও উল্টো বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গত ২২শে আগস্ট থেকে তৃণমূল পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। এরপর থেকে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও হামলার ঘটনা ঘটছে। কোথাও আবার একই জায়গায় সমাবেশ ডাকছেন সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন। বিএনপি’র নেতারা বলছেন, তারা শন্তিপূর্ণভাবেই সভা সমাবেশ করতে চান।
কিন্তু পরিকল্পিতভাবে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অহেতুক বাধা দেয়া হয়, হামলা করা হয়। চলতি মাসের শুরুর দিকে সমসাময়িক ইস্যুতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। এতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন। এছাড়া প্রতিদিনই প্রেস ক্লাব এবং দলীয় কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন, সভা, সমাবেশ করছে দলটি। এসব কর্মসূচিতে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি তারা।
তবে তৃণমূলে কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই দলটির কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে, হামলা মামলা হচ্ছে। এসব ঘটনাকে সরকারের অপরাজনীতি বলে মনে করছে বিএনপি। সম্প্রতি এক বক্তব্যে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকার দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার হীন চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা প্রদান করছে।
সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর, বানোয়াট মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার এবং বিএনপি’র সভা-সমাবেশ পণ্ড করার কাজে সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এদিকে শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলা, একই দিন রাতে যশোরে বিএনপি’র সাবেক মন্ত্রী মরহুম তরিকুল ইসলাম, জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান খানের বাড়ি, জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব এডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুর বাড়ি, জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকনের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে।
একই দিনে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায় বিএনপি’র বিক্ষোভ সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুরসহ নরসিংদী, খুলনা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, বরিশাল দক্ষিণ ও উত্তর জেলা, পটুয়াখালীতে বিএনপি’র কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটে।
এর আগে বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট আহমেদ আযম খানের গাড়ি বহরে হামলা চালায় সরকার দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
একই দিনে ফেনীর ছাগলনাইয়া, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, নোয়াখালীর সেনবাগ, খুলনার দৌলতপুর, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, নেত্রকোনার কলমাকান্দা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, পুটয়াখালী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাঙ্গামাটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। জানতে চাইলে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশের বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা যেভারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন।
এছাড়া আমরা যে ইস্যুতে কর্মসূচিগুলো পালন করছি সেখানে সাধারণ জনগণও অংশ নিচ্ছে। এখানেই সরকারের ভয়। এই ভয় থেকেই সকারদলীয় লোকেরা বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার প্রধান বলার পরেও আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। মামলা দেয়া হচ্ছে। এতে করে বোঝা যায় ওইসব এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমদু টুকু বলেন, একটা ফ্যাসিস্ট সরকার সব সময় নিপীড়ন করেই শাসন করে। এরই ধারাবাহিকতায় এই সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা করছে। তিনি বলেন, সরকারের এই হমালা-মামলা আর মনবো না। আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকার এবং পুলিশকে মোকাবিলা করবো। কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের আর পেছানোর জায়গা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, এগুলো আমাদের অপরাজনীতির প্রতিফলন। আমরা যদি গণতন্ত্র দাবি করতে চাই তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার থাকতে হবে। যেগুলো সংবিধানে বলা আছে। এসবের প্রতি যদি শ্রদ্ধাশীল আচরণ না হয় তাহলেতো আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে পারি না।
মাগুরায় আওয়ামী লীগ-বিএপি সংঘর্ষ, ককটেল বিষ্ফোরণ, মোটরসাইকেলে আগুন মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মাগুরায় বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপ ও ৭টি মোটরসাইকেলে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছে। গতকাল দুপুরে মাগুরা-ঝিনাইদহ মহাসড়কের স্থানীয় ভায়না এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৩টার দিকে বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের জন্য বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয় সদর উপজেলা পরিষদের পাশে জড়ো হয় জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। একই সময় যুবলীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে ঘটনাস্থল অতিক্রম করতে গেলে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়।
ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। এ ছাড়া ৭টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও বোমা বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সদর উপজেলা পরিষদের দু’পাশে ঢাকা-ঝিনাইদহ মহাসড়কের দু’পাশে শতশত যানবহন আটকে যায়। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি হিসাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে আমরা অনুমতিও চেয়েছি। বিশাল জনসমাবেশের জন্য আমরা শহরের বাইরে ইটাখোলা মাঠে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করি। কিন্তু আগের দিন রাত থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মহড়া দেয়।
গতকাল সকাল থেকেই ৫টি স্থানে ঘাঁটি গাড়ে তারা। দুপুরে ভায়না মোড় এলাকায় আমাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশ চলাকালে হটাৎ আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী মুহুর্মুহু ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে। এ সময় অন্তত ৭টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
এতে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তবে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ফজলুর রহমান জানান, মাগুরা পৌরসভার ১ ও ২নং ওয়ার্ডে জাতীয় শোক দিবস ও ১৫ই আগস্টের কর্মসূচি পালন শেষে একটি মিছিল নিয়ে ফিরে আসার পথে সদর উপজেলা পরিষদের পাশে বিএনপি’র পার্টি অফিস থেকে অতর্কিতে বোমা হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
এ সময় আমাদের যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদেরকে প্রতিহত করে। মাগুরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি তদন্ত) অসিত কুমার রায় জানান, উত্তেজনা এড়াতে ঘটনাস্থলসহ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বাঁশখালীতে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষ, ৪ শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩টি মামলা হয়েছে। এতে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের প্রায় ৪৫০ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা দলের আহ্বায়ক জান্নাতুল নাইম চৌধুরী রিকু, বাঁশখালী পৌরসভা মহিলা দলের আহ্বায়ক শারাবান তহুরাসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন ধারায় এসব মামলা করে থানা পুলিশ। বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন বলেন, বাঁশখালীতে শুক্রবার বিকালে বিএনপির লোকজন যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়, গাড়ি ভাঙচুর করে ও পুলিশের উপর হামলা চালায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ৩টি মামলা হয়েছে।
এসব মামলায় ৬৬ জনের নাম উল্লেখসহ ৪ শতাধিক লোককে আসামি করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান বলেন, আমরা পূর্বনির্ধারিত সমাবেশের অনুমতি নিয়েছিলাম এক জায়গায়। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা সেটি প্রশাসনের ছত্রছায়ায় দখল করে নেয়। পরে আরেকটা জায়গা সমাবেশের জন্য ঠিক করি। সেখানেও আওয়ামী লীগের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।
বাধ্য হয়ে আমরা বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়িতে সমাবেশ করি। এই সমাবেশ শেষে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করি। সেখানে পুলিশ বিনা উস্কানিতে হামলা চালিয়ে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করে।
তিনি বলেন, পুলিশ হামলা চালিয়েছে। আবার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে ৩টা মামলা দিয়েছে। রাতে বিএনপির সমর্থকদের বাড়িঘরেও পুলিশ হানা দিয়েছে। দক্ষিণ জেলা মহিলা দল সভানেত্রীসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে।
আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। উল্লেখ্য, বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে বাধা দেয়াকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার বিকালে বাঁশখালীর আলীপুরে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৬০ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে পুলিশের সার্কেল এসপি, ওসি ও থানার সেকেন্ড অফিসারও রয়েছেন।