চিরকুটে বাবাকে ‘পশু’ ও ‘রেপিস্ট’ লিখেছিল ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থী

চিরকুটে বাবাকে দায়ী করে রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানের একটি বহুতল ভবন থেকে লাফ দিয়ে বেসরকারি ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ওই শিক্ষার্থীর লেখা চিরকুট ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে।

কারণ মৃত্যুর আগে চিরকুটে তার বাবাকে ‘পশু’ ও ‘রেপিস্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবার এবং সহপাঠীদের দাবি এটা আত্মহত্যা না তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১০ তলা ভবনের ৭ তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ওই শিক্ষার্থী। তার রুমের বিছানার একটি বালিশের নিচ থেকে পরিবারের সদস্যরা নিহতের হাতের লেখা একটি চিঠি খুঁজে পান। সেই চিঠিতেই আত্মহত্যার জন্য বাবাকে দায়ী করেছেন ওই শিক্ষার্থী। যে ভবনে ওই শিক্ষার্থী থাকতেন ওই ভবনে তাদের একটি নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে।

রেন্ট এ কার (গাড়ি ভাড়া)’ ব্যবসায়ী শাহীন ইসলামের বিরুদ্ধে লেখা সুইসাইড নোটে ওই শিক্ষার্থী লিখেছেন, আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা দায়ী। একটা ঘরে পশুর সঙ্গে থাকা যায়।

কিন্তু অমানুষের সঙ্গে না। একজন অত্যাচারী রেপিস্ট যে কাজের মেয়েকেও ছাড়ে নাই। আমি তার করুণ ভাগ্যের সূচনা।’ ভুক্তোভোগী শিক্ষার্থীর মা বলেন, তার স্বামী দুটি বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে তাদের পরিবারে নিয়মিত অশান্তি লেগেই ছিল। একপর্যায়ে বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ওই শিক্ষার্থী। তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে। মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার চেয়েছেন তার মা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিহতের বাবা শাহীন ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর নির্যাতন করে আসছে বলে জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থীর স্বজনরা। এর আগে সকালে বাবার কাছে সেমিস্টার ফাইনালের জন্য টাকা চাইলে তাকে মারধর করেন বাবা।

সূত্র জানায়, নিহত শিক্ষার্থীর বাবা শাহীন আলম গত পাঁচ বছর আগে তাদের না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কয়েকদিন আগে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি জানাজানি হলে দুই পরিবারের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। এজন্য তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফিসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিতেন না।

পারিবারিক অশান্তির কারণে তিনি মানসিকভাবে ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে একটি প্রেসক্রিপশন পাওয়া গেছে। গত মার্চেও মানসিক রোগের জন্য তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তাতে তার আত্মহত্যার প্রবণতা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে পারিবারিক অশান্তি এবং তার বাবার মারধরের কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন তার সহপাঠীরা। ওইদিন সকালে বাবার কাছে সেমিস্টার ফাইনালের জন্য টাকা চাইলে তাকে মারধর করেন। তার একাধিক সহপাঠী জানায়, তার বাবা তাকে প্রায়ই মারধর করতেন। মারধরের কারণে মাঝে মাঝে সে ক্লাসে আসতে পারতো না। তার হাত ও শরীরে মারের দাগ রয়েছে। তার বাবা চার-পাঁচ বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

এই শিক্ষার্থী তার মায়ের সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকতেন। এক মাস ধরে বাবা মো. শাহিন ওই বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। বাসা থেকে পড়াশোনার জন্য টাকা না দেয়ায় লাস্ট সেমিস্টার তিনি পড়তে পারেননি। যদিও শিক্ষার্থী পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। গত রমজানে তাকে মেরে তিনদিন বিছানায় ফেলে রেখেছিলেন।

বিভিন্ন সময় তার মাকে বাবা মারতে গেলে শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করলে তখন তাকেও মারা হতো। বাবার মারের কারণে তার হাত ভেঙে যায়। ঘটনার দিন সকালে সেমিস্টার ফি’র টাকা নিয়ে ঝগড়া বাধে। এ সময় তার বাবা তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে। হাত বাঁধা থাকলে যে রকম দাগ হয় ওর হাতে সে রকম দাগ রয়েছে। তাকে প্রায়ই মারধর করার বিষয়টি প্রতিবেশীরা ইতিমধ্যে পুলিশকে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনা উল্লেখ করে তার বাবাকে একমাত্র আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর-৫৮। শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় তার হাতের লেখা একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। চিরকুটে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন (যৌন হয়রানি)’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিরকুটটি শিক্ষার্থীর হাতের লেখা কিনা এবং তার লেখা অভিযোগগুলো সত্য কিনা সেগুলোকে সামনে রেখে তদন্ত করছে পুলিশ। এ ঘটনার পরপরই পলাতক রয়েছে নিহতের বাবা। তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *