যে কারণে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন আসিফ আকবর
৮ ডিসেম্বর ২০০৯ ছিল বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করা হয়েছিল এ কাউন্সিলের।
কাউন্সিল আয়োজনের জন্য নয়টা শাখার এক সমন্বিত কমিটি কাজ করেছিল। তার মধ্যে সাংস্কৃতিক শাখার প্রধান ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সদস্য সচিব আসিফ আকবর।
কাউন্সিলের দুই দিন আগে বেগম জিয়া আসবেন ভেন্যু পরিদর্শন করতে। আসিফও গেলেন বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে।
কেন্দ্রের হল অব ফেম এর মঞ্চটা ছোট। সাধারণত স্থায়ী মঞ্চের সঙ্গে আরো দুই-চার ফুট যোগ করে মঞ্চ তৈরি করে নেয় সবাই। আসিফের তা বেশ ভালো করেই জানা আছে।
আসিফ বিএনপি নেতা মীর্জা আব্বাসকে জানালেন ব্যাপারটা। মীর্জা আব্বাসের ডেকোরেশন প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে।
মীর্জা আব্বাস বললেন, এটা আর এখন কিছু করা যাবে না। যা আছে থাক।
আসিফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দলের জাতীয় কাউন্সিল। এখানে কেন জোড়াতালির কাজ হবে, বুঝতে পারলেন না। এমন নয় যে দল অর্থসঙ্কটে ভূগছে।
বেগম খালেদা জিয়া ভেন্যুতে এসে আসিফকে খুঁজছেন। আসিফকে দেখতে না পেয়ে বললেন, ও কোথায়? ওকে ডাকো।
বেগম জিয়ার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদ বললেন, ম্যাডাম আসিফের মেজাজ খারাপ।
বেগম জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
আসিফের কাছেই শোনেন। তিনি উত্তর দিলেন।
আসিফকে ডেকে আনা হল। বেগম জিয়া বললেন, কী হয়েছে আসিফ? তোমার নাকি মেজাজ খারাপ?
আসিফ বললেন, ম্যাডাম, এই মঞ্চটা ছোট। এটা আরো চার ফুট বড় হওয়া দরকার। সবাই সেটা করে। এত ছোট মঞ্চে হাটা-চলাফেরা করাও মুশকিল।
বেগম জিয়া তাকালেন মীর্জা আব্বাসের দিকে, কী ব্যাপার আব্বাস?
মীর্জা আব্বাস একটু ইতস্তত। তাৎক্ষণিক পা দিয়ে মঞ্চ মাপার উদ্যোগ নিলেন।
বেগম জিয়া বললেন, আসিফ তুমি এগুলোর দায়িত্ব বুঝে নাও। কী কী করতে হবে, কিভাবে করলে সুন্দর হবে, তোমার দায়িত্বে করো।
আসিফ বললেন, ম্যাডাম টাকা লাগবে। আমাকে যে টাকা দেয়া হয়েছে তার থেকে আট লাখ টাকা দিয়েছি গাজী চাচাকে (গাজী মাজহারুল আনোয়ার), জাসাসের ছেলে-মেয়েদের রিহার্সেল টিহার্সেল, পেমেন্ট কী কী লাগবে সেজন্য। আমার কাছে আছে সাত লাখ টাকা। এই মুহূর্তে নূন্যতম আরো দশ লাখ টাকা লাগবে।
বেগম জিয়া তাৎক্ষনিক সহ-দপ্তর সম্পাদক হুকুম দিলেন, এই শামীম, আসিফকে দ্রুততার সঙ্গে টাকা দিয়ে দাও। এটা নিয়ে যেন কোনো গড়িমসি না শুনি।
তারপর বেগম জিয়া আসিফের দিকে ঘুরে বললেন, তারপর বলো, তোমার আর কী লাগবে?
আসিফ বললেন, আর কিছু লাগবে না ম্যাডাম। আপাতত এটা দিয়েই কাজ সারতে পারব।
বেগম জিয়ার সঙ্গে আসিফের আত্মবিশ্বাসী কথা বলার ঢঙ উপস্থিত অন্যদের বিস্মিত করে তুলল। তারা হা করে দুজনের কথপকথন শুনতে লাগলেন।
বেগম জিয়ার তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়ার এই বিশেষ গুণের সঙ্গে আসিফ আগেও পরিচিত। এই গুণের ভক্ত আসিফ। তিনি নিজেও চটপটে মানুষ। যখন যা দরকার তখনই সেটা করে ফেলতে পছন্দ করেন। তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে সিদ্ধহস্ত আসিফ। বেগম জিয়ার মধ্যেও এই গুণটি দেখতে পেয়ে আসিফ ভাবেন, এ জন্যই দলটা এখনো টিকে আছে। তার মতো ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব আছে বলেই বিএনপি এতদূর আসতে পেরেছে।
পুরো কাউন্সিলে আসিফ সুশৃঙ্খলভাবে দায়িত্ব পালন করলেন। কোথাও কোনো কিছু নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকলো না।
বিএনপির এ কাউন্সিলের মাধ্যমে আসিফ প্রথমবার দলের সঙ্গে খাতা-কলমে যুক্ত হলেন।
দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হিসেবে মনোনীত হলেন।
কাউন্সিলে তারেক রহমান লন্ডন থেকে লাইভ বক্তব্য দিলেন। কর্মীদের উজ্জীবিত করলেন। বক্তব্যটি অবশ্য লাইভ ছিল না। গোয়েন্দা নজরদারীর কারনে সম্ভবও ছিলনা। রেকর্ডেড বক্তব্যটি লাইভ বলে প্রচার করা হয়েছে কর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব আনার জন্য। এটা অবশ্য আসিফ ছাড়া আর জানতেন মাত্র দুজন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং বেগম জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল।
মারুফ কামাল খান সোহেলকে আসিফের ভালো লাগে। নির্লোভ মানুষ সোহেল। দীর্ঘদিন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আছেন। দলীয় বহু নেতা-কর্মী তার কাছে তদ্বির নিয়ে আসেন। উপঢৌকন সাধেন। মারুফ কামাল খান সোহেল সবিনয়ে সেসব ফিরিয়ে দেন।
এই দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা টাকার কুমির হয়ে যান। সোহেল উল্টো। তার সিগারেট খাওয়ার টাকা থাকে না পকেটে। সে কারণেই তার সিগারেটের নির্দিষ্ট কোনো ব্রান্ড নেই। যে যখন যে ব্রান্ডের সিগারেট গিফট করে, তখন সেটাই খান।
দলের এই কনিষ্ঠতম নির্বাহী সদস্য খুব শিগগিরই একটা ভুল করে বসলেন।
বেগম জিয়া তাকে নিষেধ করেছিলেন কুমিল্লার রাজনীতিতে জড়াতে। আসিফ জড়িয়ে গেলেন।
কুমিল্লার এক রাজনৈতিক সমাবেশে আসিফ গিয়েছেন। সেখানে উপস্থিত দক্ষিন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রশীদ ইয়াছিন। স্থানীয়রা তাকে হাজী ইয়াছিন নামে ডাকেন। এই হাজী ইয়াছিন এর জন্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসিফ গাঁটের পয়সা খরচ করে জনসমাবেশ করে বেড়িয়েছেন। তার জন্য ভোট চেয়ে বেড়িয়েছেন। আসিফের সুপারিশেই তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
মঞ্চে আসিফকে যখন ডাকা হল, তখন উপস্থাপক কুমিল্লা জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন কায়সার বললেন, এবার বক্তৃতা দিতে আসছেন আমাদের কুমিল্লার সন্তান কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর।
ঘোষণাটা আসিফের মনোপুত হল না। তিনি শুধু কণ্ঠশিল্পীই না, দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য। আর এটা গানবাজনার আসর না, রাজনৈতিক মঞ্চ। এখানে তার রাজনৈতিক পরিচয় দেয়া প্রয়োজন ছিল।
এটা নিয়েই আসিফের সঙ্গে বিতণ্ডা শুরু হল। আসিফ মেজাজী মানুষ। খুব অল্পতেই মেজাজ হারান। এখানেও তাই হল। ঘুষি মেরে বসলেন।
এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা বাঁধতে সময় লাগল না। এক ধরণের হৈ হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। ভীড়ের মধ্যে আসিফের লোকজনরে সঙ্গে হাজী ইয়াছিনের লোকজনের কিছুক্ষণ ঘুষোঘুষি হল।
আসিফ বাংলাদেশে টপ সেলিব্রটি। এমন একটা খবর রাষ্ট্র হতে সময় লাগল না। দেশে এখন চলে এসেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। যখন খবর, তখনই পরিবেশন। এ ছাড়া টিভি চ্যানেল তো রয়েছেই। খবর হয়ে গেল– কুমিল্লায় আসিফ নিগৃহীত।
ঘটনার পর আসিফ মামলা করলেন। রাতে ঢাকা চলে আসলেন। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ভোরে শুটিং করতে গেলেন সাভার গলফ ক্লাব-এ।
ক্রিকেট নিয়ে আসিফের গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় ‘সাবাশ বাংলাদেশ‘ এর শুটিং ছিল। গানটা এটা ছিল বিসিবির প্রথম থিম সং
এদিকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। আসিফ আকবরের ফ্যান-ফলোয়াররা দেশের নানান প্রান্তে মানব-বন্ধন, মিছিল বের করেছেন। আসিফ আকবরের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে –এমন শ্লোগানও শোনা গেল। কুমিল্লা শহরেও মানব বন্ধন হল।
আসিফ এসবের কোনো খবরই রাখলেন না। শুটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়লেন।
ওদিকে বিএনপি নেতৃত্ব আসিফকে খুঁজে হয়রান। বেগম খালেদা জিয়ার কানে খবরটা পৌঁছেছে। তিনি দলের সিনিয়ত নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দিয়েছেন আসিফের সঙ্গে কথা বলতে।
কুমিল্লা কোতোয়ালী থানায় মামলা করেছেন আসিফ। এর পরপরই ফোন করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বললেন, নিজেদের মধ্যে সমস্যা, কী দরকার ছিল মামলা করার, আমিতো ছিলামই !!
আসিফ বেশি কিছু বললেন না। খন্দকার মোশাররফের কথা বলার ধরণ ভালো লাগে নাই তার।
খন্দকার মোশাররফকে আসিফ ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু আজ যেভাবে কথাগুলো বললেন, কোনোভাইে আসিফের তা ভালো লাগে নাই।
মুহূর্তে আসিফ সিদ্ধান্ত নিলেন, দল থেকে পদত্যাগ করবেন। তার আগে নিজের সঙ্গে বাইরের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখলেন। তার পদত্যাগ নিয়ে মিডিয়াতে কাঁদা ছোড়াছুড়ি হোক, তা তিনি চান না। দল এমনিতেই সরকারের বাইরে। এবং বিপদগ্রস্ত। তার জন্য নতুন কোনো ঝামেলা দলকে পোহাতে হোক, তা তিনি চান না।
বিকালে রুদ্রকে নিয়ে মিতু গেলেন বিএনপির নয়া পল্টন কার্যালয়ে। তার হাতে একটা কাগজ। সেই কাগজের উদ্ধৃতি দিয়ে চ্যানেল আই ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে– দল থেকে পদত্যাগ করলেন আসিফ।
মিতু সরাসরি তার পদত্যাগপত্রটি নিয়ে মীর্জা ফখরুলের হাতে দেন।
এ খবর শুনে বেগম জিয়া প্রশ্ন করলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে, আপনাকে বললাম ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। কী এমন কথা বললেন যে ছেলেটা পদত্যাগই করে বসল?
***
সোহেল অটল-এর লেখা বায়োগ্রাফি বুক “আকবর ফিফটি নট আউট” থেকে
***