বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ‘বিকল্প প্রশাসন’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে গড়ে উঠেছে বিকল্প প্রশাসন। এই অঘোষিত প্রশাসনের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ হয় সব কিছু। হলে সিট বরাদ্দ, নানা বিষয়ের বিচার-শাস্তি ঠিক করে দেয় এই ছায়া প্রশাসন।
ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাদের হাতে থাকে সব নিয়ন্ত্রণ। হলে হলে প্রভোস্ট থাকলেও তাদের অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করে ওই ছায়া প্রশাসন। তাদের কথামতোই কাজ করতে হয় প্রভোস্টকে। কখনো কখনো তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে রোষানলে পড়তে হয় প্রভোস্টদের। ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে নিজেদের মধ্যে আলোচনা। এই আলোচনার একটি কথার জের ধরে পুলিশে দিলেন প্রভোস্ট। এদিকে পুলিশ কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় ছেড়ে দেন শিক্ষার্থীকে।
হলে থাকা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক একজন প্রভোস্টের এমন আচরণ বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এনিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বেশ। এই ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের। কিন্তু দেশব্যাপী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের চিত্রই যেন এক।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেখানে নীরব, গা বাঁচিয়ে চলেন। হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্টরা হলের দায়িত্বে থাকলেও তারা যেন ঢাল তলোয়ারবিহীন যোদ্ধা। ইডেন মহিলা কলেজ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনা।
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতির রুঢ় আচরণ প্রকাশ্যে এসেছে গণমাধ্যমে। এই কলেজের হলে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রভোস্টরা অনেক সময় হলে হিটার, ইলেকট্রিক ক্যাটেল, হেয়ার ড্রায়ার বাজেয়াপ্ত করতে আসেন। কিন্তু কখনই হলের নেত্রীদের কক্ষে যান না। আর এসব নেত্রীদের হাতে থাকে হলের রুম। তারাই ভাড়া দেয়া থেকে শুরু করে বরাদ্দ করেন।
সিট পাবার জন্য দিতে হয় স্বর্ণের অলংকার থেকে শুরু করে দামি উপহারও। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনাও আলোচনায় এসেছে। বঙ্গবন্ধু হলে আল আমিন নামের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে তিন ঘণ্টার বেশি নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষার্থী ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এই নির্যাতনের ঘটনা তিনি প্রভোস্টকে জানাননি। কারণ প্রভোস্টদের প্রতি সেই আস্থাটুকুই গড়ে ওঠেনি।
ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। প্রতিনিয়ত অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্যু ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর শিক্ষার্থী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের শিক্ষার্থীরা সিটের দাবিতে হল ছাত্রলীগ নেতার কক্ষের সামনে অবস্থান করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন প্রভোস্ট বলেন, প্রভোস্টদের দায়িত্ব হলের নিয়ন্ত্রণ রাখা। দেখভাল করা। কিন্তু তারা চাইলেও ক্ষমতাসীনদের বাইরে যেতে পারবেন না। আর তারা ক্ষমতসীনদের পক্ষে কাজ করার প্রত্যয় থেকেই এই দায়িত্ব পান। জিয়া হলের ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রভোস্টের উচিত ছিল সেই শিক্ষার্থীকে নিরাপদে রাখা। তারা কি করলেন উল্টা পুলিশের কাছে সোপর্দ করলেন।
একজন অভিভাবক হিসেবে এটা কতোটা যুক্তিযুক্ত? মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট বিল্লাল হোসাইন বলেন, আমাদের কাছে প্রমাণ ছিল বলেই অধিকতর যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছি। আমরা জানতে পারি, তিনি বিরোধী যে শক্তি সেই শক্তির স্বপক্ষে যেগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে সেগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি ডিজিট্যাল ভায়োলেশন কনটেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
আবার এই হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, হলের এই ঘটনার সময় বেশ উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে পুলিশে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এরই প্রেক্ষিতে তিনি পুলিশের কাছে দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, এখন আমি মেসে থাকি। আমি শুরুতে হলে থাকতাম। গেস্টরুমে নানা শারীরিক মানসিক নির্যাতন সহ্য করি। এরপর নতুন শিক্ষার্থীরা যখন গণরুমে আসেন আমাদের একটি রুমে দেয়া হয়। এক রুমে আমাদের আট জনের স্থান হয়। তখনও আমি বৈধ সিট পেয়েছি। আমার এলাকার এক বন্ধু ও খালাতো ভাই হলে এসেছিল।
তারা ইসলামিক মাইন্ডেড সেইসঙ্গে ইসলামিক পোশাক পরে। এরপর বড় ভাইয়েরা তার ছাত্রলীগের বড় ভাইদের জানান। এরপর একদিন রাতে রুমে ডাকা হয়। আমার ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসআপ, গুগল হিস্টোরি, ইউটিউব হিস্টোরি চেক করে। নানাভাবে মানসিক নির্যাতন চালায়। এরপর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায় না। এরপরও কয়েকদিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
বাধ্য হয়ে আমি হল ছেড়ে দেই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য ঘোষিত ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত এক নেতা বলেন, আমাদের শাখা ছাত্রলীগের ঊর্ধ্বতন থেকেই বলা হয় নিয়ন্ত্রণের জন্য। আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সংগঠনে পদ থাকবে না। ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভীত করে রাখাই প্রধান উদ্দেশ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের বাম রাজনীতি করা একজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যারা বাম রাজনীতি করি হলে থাকতে পারি। তবে আমাদের সংখ্যাটা শূন্যের কোঠায়।
কিন্তু সবসময় একটা ভীতির মধ্যে থাকতে হয়। ছাত্রলীগের চোখে এমন কোনো কাজ যেটা অপরাধ সেটা করলেই আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। আমরা যেহেতু সংখ্যায় কম সেহেতু আমাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। এই হলে ছাত্রলীগ চাইলে সবই সম্ভব। তাদের বাইরে প্রভোস্টদের কিছু করার কোনো ক্ষমতা নেই। তিনি আরও বলেন, এমনও হয়েছে প্রভোস্ট স্যার ছাত্রলীগের ‘হ্যাঁ’র জন্য অপেক্ষা করেছেন।
আর ছাত্রলীগের না থাকলে কোনো হলের প্রভোস্টের ক্ষমতা নেই সিট বরাদ্দ দেয়া। নাগরিক ছাত্র ঐক্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, বর্তমানে চাঁদাবাজি ও সিট বাণিজ্য ছাত্রলীগের রুটিন কাজ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসকল বিষয়ে পুরোপুরি নীরব থাকে বা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর কারণ হলো কোনো ঘটনা ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাস্তির ব্যবস্থা না করে সমঝোতা করে।
এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ হতে পারে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট সুজন সেন বলেন, এখানে নিয়ন্ত্রণের বিষয় না। অফিসিয়াল কাজ আমাদেরই করতে হয়। সিট বরাদ্দ তো আমরাই দেই। ছাত্রলীগ যা করছে এটা তাদের ব্যক্তিগত। কিন্তু আমরা যখন শিক্ষার্থীদের বলি তারা লিখিত অভিযোগে কিছু বলে না। এদিকে শনিবার ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে অবরুদ্ধ হন সহকারী প্রক্টর রিজওয়ানুল হক। এই হলের প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হন।
নির্যাতনের ঘটনায় অভিভাবকেরা শঙ্কিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রিজওয়ানুল হক তাদের নিয়ে শনিবার রাত ১০টার শাহজালাল হলে যান। নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গেলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সহকারী প্রক্টরকে হলে আটকে রাখেন। একপর্যায়ে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী সহকারী প্রক্টরকে মারধর করতেও উদ্যত হন। এই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন সাংবাদিকরাও।
রোববার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার তায়েফুর রহমান ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জড়িত কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান লিটন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনকেন্দ্রীক রাজনীতি নেই। আমি বলব, যারা রাজনীতি করে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর থেকে একটু বেশি কষ্ট করে থাকে।
এ ছাড়াও হল প্রশাসন আছে তাদের আমরা যেকোনো সময় সাহায্য চাইলে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত থাকি। প্রভোস্টরা আমাদের অভিভাবক। এখানে সিট পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রাজনীতি নেই। তিনি আরও বলেন, হলে কর্তৃত্ব দেখানোর কিছু নেই। ছাত্রলীগের রাজনীতি করা কোনো নেতাই জোরপূর্বক কোনো অনুষ্ঠানে নেয় না। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, দেশে ক্ষমতাসীনরা সবসময় কর্তত্ব ধরে রাখতে চায়। আর বিরোধী শক্তি না থাকায় এটা অধিক মাত্রায় গিয়েছে। এদিকে আছে শিক্ষকদের দলাদলি। এসব বিষয়ে আশু নজর দেয়া প্রয়োজন। দেশের উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু অধ্যয়নের পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা অনুধাবন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।