৬৩ মিশনে হাহাকার

ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের ধীরগতিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যথাসময়ে মিলছে না পাসপোর্ট। তথ্য সংশোধন ও নবায়নে হয়রানি সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কয়েকটি দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা পাসপোর্টের জন্য রীতিমতো হাহাকার করছেন। ভোগান্তির মুখে প্রবাসীদের ক্ষোভ দিনদিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে ইতালি দূতাবাসে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

সূত্র বলছে, বর্তমানে অন্তত ৬৩টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে পাসপোর্ট সেবায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা। এসব মিশনে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। আবার মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট পেতেও বহু কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কয়েকটি দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট ও বসবাসের অনুমতি (পিআর) পেতে বিড়ম্বনার শেষ নেই। মিশনে ধরনা দিয়েই কারও কারও কর্মঘণ্টা শেষ হচ্ছে।

এই যখন অবস্থা, তখন পাসপোর্টের অভাবে কারও কারও দেশে ফেরাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের লক্ষ্যে সরকার জার্মান প্রতিষ্ঠান ভেরিডোজের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই। শর্ত ছিল দুই বছরের মধ্যে দেশের সব পাসপোর্ট অফিস ছাড়াও ৮০টি মিশন ই-পাসপোর্টের আওতায় আনা হবে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১৭টি মিশনে ই-পাসপোর্ট চালু হলেও বাকিগুলো পড়েছে গভীর অনিশ্চয়তায়।

সূত্র বলছে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইতালি ও যুক্তরাজ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। ফলে এই তিনটি দেশে পাসপোর্টের চাহিদা সর্বাধিক। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তেহরান, জাপান, বেইজিং, হংকং ও ভারতের ৫টি মিশনে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু করা দরকার।

কিন্তু মিশনগুলোয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এখনো পৌঁছায়নি। ফলে এসব মিশনে ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে না। আবার নতুন করে এমআরপির জন্য আবেদন জমা দিলেও মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাসপোর্ট নিয়ে একেক দূতাবাস থেকে একেক ধরনের কথা বলা হচ্ছে। কোথাও ই-পাসপোর্ট চালুর আগে নতুন করে এমআরপির আবেদন নেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। কোথাও আবার আবেদন জমা নিলেও তা পড়ে থাকছে মাসের পর মাস। তদুপরি পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে গেলে অনেক দূতাবাসেই নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। এছাড়া তথ্য সংশোধন ও নবায়নে কয়েকটি মিশনের পাসপোর্ট শাখা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীদের অনেকে।

সূত্র জানায়, পাসপোর্ট নিয়ে প্রবাসীদের ভোগান্তির বিবরণ দিয়ে কয়েকটি মিশন থেকে ঢাকায় একাধিক তাগাদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, ইতালি, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহাম মিশন দ্রুত পাসপোর্ট সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছে। অন্যথায় শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদিতে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন। সেখানে পাসপোর্টের চাহিদা প্রতিমাসে ৩ হাজারেরও বেশি। এছাড়া মালয়েশিয়ায় দৈনিক ২ হাজার পাসপোর্টের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সৌদি বা মালয়েশিয়াকে বাদ দিয়ে অজ্ঞাত কারণে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি মিশনে ই-পাসপোর্ট চালু করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নতুন মিশন খোলা হলেও সেখানে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এছাড়া ভারতের গুহাটি ও যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে খোলা বাংলাদেশ মিশন থেকে পাসপোর্ট সেবা মিলছে না।

রোববার পাসপোর্ট অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রবাসীদের পাসপোর্ট সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে ভিড় করছেন তাদের স্বজনরা। এমনকি প্রবাসীদের অনেকে দেশে ছুটে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের পাঠানো হচ্ছে ভবনের চতুর্থ তলায় পাসপোর্ট শাখায়। সেখানে কাগজপত্র হাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে

অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু অনেকেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। দেখা যায়, চতুর্থ তলায় সরু বারান্দার দুই পাশে কাচঘেরা কক্ষে বসে আছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দেওয়ালে সাঁটানো কাগজে কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি লেখা-সহকারী পরিচালক আজিজুল ইসলাম, অর্জুন ঘোষ, সহকারী পরিচালক হালিমা খাতুন শম্পা। আজিজুল ইসলামের কক্ষে ঢুকতে গেলে কয়েকজন ভুক্তভোগীকে বাধা দেন দায়িত্বরত আনসার সদস্য ও স্টাফরা। তারা বলেন, ‘স্যার ব্যস্ত আছেন। এখন দেখা করা যাবে না। পরে আসেন।’

ভুক্তভোগীরা জানান, অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কর্মকর্তাদের টেবিলে যাওয়া নিষেধ। ফোনে বা বিশেষ মাধ্যমে তদবির করতে পারলে তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অন্যথায় তাদের হাতে অন্যের সমস্যা শোনার মতো সময় নেই। তবে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। যাদের মাধ্যমে ঘুস চ্যানেলে যোগাযোগ করলে কাজ হয়ে যায়। পাসপোর্ট শাখায় কর্মরত ইমরান নামের এক অফিস স্টাফের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। এছাড়া আনসার সদস্য মাহবুব ও মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র বলছে, ই-পাসপোর্ট দিতে না পারায় বিকল্প হিসাবে অর্ধশতাধিক মিশন থেকে এমআরপি দেওয়া হচ্ছে। এজন্য ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪০ লাখ এমআরপি বুকলেট কিনেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কিন্তু এতেও জটিলতা কাটছে না। কারণ এমআরপি প্রিন্টিং মেশিন মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে পড়ায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বুকলেট ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। হঠাৎ করেই কারিগরি জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

কিন্তু খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে দ্রুততম সময়ে মেরামত করাও যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেশিন মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এতে সরকারি অর্থের অপচয় হবে বলে মনে করছেন খোদ পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ই-পাসপোর্ট চালুর পর এখন নতুন করে এমআরপি প্রিন্টিং মেশিন মেরামতের ফলে বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাবে।

এক্ষেত্রে দুর্নীতির শঙ্কাও রয়েছে। বরং চাহিদা অনুযায়ী ই-পাসপোর্ট প্রিন্টিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং অবশিষ্ট মিশনগুলোয় দ্রুততম সময়ে ই-পাসপোর্ট চালুর কোনো বিকল্প নেই। প্রবাসীদের পাসপোর্ট ভোগান্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে হচ্ছে তা বলা যাবে না।

কারণ, ইতোমধ্যে ৪০ লাখের বেশি ই-পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৩৩ লাখ বুকলেট রেডি অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হচ্ছে। সংকট মোকাবিলার জন্য আরও ৩০ লাখ বুকলেট রেডি অবস্থায় জার্মানি থেকে আনা হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই অবশিষ্ট মিশনগুলোয় ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম শুরু হবে।

উৎসঃ jugantor

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *