ফরিদপুরে তিন প্রেসিডিয়ামের এলাকায় নৌকার ভরাডুবি: নেপথ্যে কী?

ফরিদপুরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অধিকাংশ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। তাও আবার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী তিন প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, কাজী জাফরউল্লাহ এবং আব্দুর রহমানের এলাকায়। নেতাকর্মীদের অভিযোগ মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপিদের ভূমিকা না থাকায় তিন প্রেসিডিয়াম মাইম্যানদের সুপারিশ করায় নৌকার এমন পরাজয়।

ফরিদপুর-১: এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানের বাড়ি এবং তিনি স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গার ইউনিয়নগুলোতে আব্দুর রহমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিতরাই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন।

সম্প্রতি বোয়ালমারী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে চরমভাবে নৌকার পরাজয়। আব্দুর রহমানের বাড়ি মধুখালী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ৬টিতেই নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছে তার মধ্যে খোদ আব্দুর রহমানের নিজের ইউনিয়ন কামালদিয়াতেও নৌকার পরাজয় হয়েছে। এছাড়া আলফাডাঙ্গায় ৩টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে তার ১টিতে নৌকার পরাজয়।

ফরিদপুর-১ আসনে নৌকার পরাজয়ের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, এই আসন হলো নৌকার ঘাঁটি। এখানে নৌকার পরাজয়ের রেকর্ড নাই কিন্তু এবার অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে মনোনয়ন দেয়ায় নৌকা হেরেছে।

স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের অনুসারী। সেই নেতার নির্দেশে উপজেলা থেকে তার পছন্দের ব্যক্তিদের নামের সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠানো হয় এবং সেই সুপারিশকৃতরাই নৌকা পেয়েছেন। অযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়ায় নৌকার এমন পরিণতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

ফরিদপুর-৩: আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা সালথা, নগরকান্দা। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অসুস্থ থাকায় পুত্র শাহদাব আকবর চৌধুরী (লাবু) তার রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে সালথা ও নগরকান্দার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে লাবু চৌধুরীর অনুসারীরা নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। সালথা এবং নগরকান্দায় ৩টি করে মোট ৬টি ইউনিয়নে নৌকার পরাজয় হয়েছে।

ফরিদপুর-৪: এই আসন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহর নির্বাচনী এলাকা। বিগত ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) এর সাথে নৌকা প্রতীক নিয়ে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফলে ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনের ইউনিয়নগুলোতে তার অনুসারী হিসেবে পরিচিতরাই নৌকার মনোনয়নয় পেয়েছেন।

কাজী জাফরউল্লাহর নিজের বাড়ি ভাঙ্গা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ১১টিতে নৌকার পরাজয় হয়েছে বহু ভোটের ব্যবধানে। সদরপুর উপজেলায় ৯টি ইউনিয়নের ৭টিতেই নৌকার প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়।

তার মধ্যে চর মানাইর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ৫৪টি, চর নাসিরপুরে ১০১ ভোট, চর বিষ্ণুপুরে ৪৭৫ ভোট পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী। এছাড়া সদরপুর ইউনিয়নে নৌকা কোনো প্রার্থীই দিতে পারেনি। একই অবস্থা চরভদ্রাসন উপজেলাতেও। এখানকার ৪টি ইউনিয়নের নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে ৪টি ইউনিয়নেই নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। তার মধ্যে ঝাউকান্দা ইউনিয়নে নৌকার কোনো প্রার্থীই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ও ভাঙ্গার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের এই আমলে ফরিদপুর-৪ আসনে যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে কোনোভাবেই নৌকা হারার কথা না।

নৌকা হেরেছে শুধুমাত্র কাজী জাফরউল্লাহর কারণে। তিনি নিজের আধিপত্যের জন্য অযোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়নের সুপারিশ করায় নৌকার এমন পরিণতি। অধিকাংশ ইউনিয়নেই এমপি নিক্সন চৌধুরীর প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন তারাও আওয়ামী লীগের। সুতরাং তৃণমূলের সাথে আলোচনা করে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে নৌকা ডুবতো না। নৌকা ডুবেছে মাঝির কারণে।

ফরিদপুরে নৌকার ভরাডুবির বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগে কয়েকজন নেতা বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, তৃণমূলের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা না করে মনোনয়ন বাণিজ্য, নিজস্ব বলয় তৈরি এবং মাইম্যানদের প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে সুপারিশ করেছেন তিন প্রেসিডিয়াম মেম্বার। এজন্যে এই নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে তাদের সুপারিশ করা ব্যক্তিকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে নৌকার পরাজয় হয়নি, পরাজয় হয়েছে ব্যক্তির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *