আকাশসীমার কোনো তথ্য পেতে হলেও দারস্থ হতে হয় ভারত ও মিয়ানমারের!
আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্র সীমানা বুঝে পেলেও সেই সীমানার ওপরের আকাশসীমায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বাংলাদেশ। নির্ধারণ করতে পারেনি আকাশপথে নিজেদের উড্ডয়ন তথ্য অঞ্চল বা এফআইআর (ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওন)। কারণ এটি নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র (রাডার) বাংলাদেশের কাছে নেই।
এর ফলে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হয়েও বাংলাদেশের আকাশসীমার বড় একটি অংশ এখনো প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনকি এই সীমানা দাবি করার শর্ত পূরণ করতেও কয়েক বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে একটি রাডারের অভাবে প্রতিদিন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অন্য কোনো দেশের উড়োজাহাজ কতবার চলাচল করছে তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিদেশি উড়োজাহাজ চলাচলের ওভার ফ্লাইং চার্জ বা উড্ডয়ন ফি চলে যাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারের কাছে। এমনকি আকাশসীমার কোনো তথ্য পেতে হলেও দারস্থ হতে হয় ও দুই দেশের।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিষয়টি শুধু যে বাংলাদেশের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ এমন নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা জয় করেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব একটি রাডার স্থাপন করতে হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেদের আকাশ সীমার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১২ সালে মিয়ানমারের এবং ২০১৪ সালে ভারতের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। এরপর ২০১৫ সালে বঙ্গোপসাগরে সীমান্ত বেসলাইন নির্ধারণ করা হয়। ২০১৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিষয়টি তোলা হয়। সেবারই প্রথম আকাশপথে চলাচলের বিষয়টি সার্বভৌম করতে এফআইআর সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। বঙ্গোপসাগরে পাওয়া ভূখণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে সাগরের বুকেও বাংলাদেশের মানচিত্র সমন্বয় করে নেয়া জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্রসীমা জয়ের পরও বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরের বুকে পাওয়া ভূখণ্ডের ওপরে আকাশসীমার সার্বভৌমত্ব আদায়ের বিষয়টি কারও মাথায় আসেনি। যার ফলে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো আকাশসীমা দাবি করার মতো পর্যায়ে বাংলাদেশ নেই।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার প্রধান শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের একটি রাডার থাকতে হবে যেটির ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বের একটি উড়োজাহাজকে অ্যালার্ট করার বা সংকেত দেয়ার সক্ষমতা থাকবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো যন্ত্র এখনো বাংলাদেশের কাছে নেই।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, আলোচনা শুরুর পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যাটি সমাধানে চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারত ও মিয়ানমার এফআইআর পরিবর্তনে বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিলেও বাংলাদেশের যে প্রয়োজনীয় রাডার নেই সেটি মনে করিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা শুরু করার আগে বাংলাদেশকে নিজস্ব রাডার স্থাপন করতে হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণ সুন্দরবন ধরে আকাশপথে উড্ডয়নের আন্তর্জাতিক রুটের একটি অংশ কলকাতা এফআইআর ৫০৭ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর সেন্ট মার্টিনের একটি অংশ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়েছে ইয়াঙ্গুন এফআইআরের অধীনে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশন-আইকাও) তথ্য অনুযায়ী, এফআইআর হচ্ছে উড়োজাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে আকাশপথের একটি বিশেষায়িত এলাকা। এর মাধ্যমে ফ্লাইট চলাচলের তথ্য ও সতর্কবার্তা দেয়া হয়। সাধারণত ছোট দেশগুলোতে একটি এফআইআর থাকে আর বড় আয়তনের দেশগুলোর থাকে একাধিক এফআইআর। প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা ছাড়াও মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই- তিনটি এফআইআর আছে। মিয়ানমারের আছে দুটি। বাংলাদেশের একটি এফআইআর আছে।
বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেবিচকের দুটি রাডার (ঢাকা ও চট্টগ্রামে) থাকলেও সেগুলো সর্বোচ্চ ২৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নেভিগেশন করতে পারে। কিন্তু এটি দিয়ে বাংলাদেশের অর্জিত নতুন সমুদ্রসীমার ওপরের আকাশসীমার এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই ওই এলাকার আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক গন্তব্যের ফ্লাইট থেকে বাংলাদেশ উড্ডয়ন ফি (ওভার ফ্লাইং চার্জ) আদায় করতে পারছে না।
তবে আশার কথা হলো, গত বছর একটি রাডার কেনার বিষয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ফ্রান্স থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে রাডারটি কিনতে ব্যয় হবে ৬৫৮ কোটি ৪০ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের আকাশ ব্যবস্থাপনা উন্নত করার লক্ষ্যে আমরা একটি সিএনএস-এটিএম সিস্টেমসহ অত্যাধুনিক রাডার স্থাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। ফ্রান্সের রাডার প্রস্তুতকারী কোম্পানি থ্যালাস এলএএস এই রাডারটি সরবরাহ করছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে এটি স্থাপন করার কাজ শেষ হবে।
তবে বেবিচক সূত্র জানায়, একটি রাডার বসলেই যে বাংলাদেশ আকাশসীমা বুঝে পাবে বিষয়টি এমন নয়। মূলত এ বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে একমত হতে হবে। তিন দেশ একমত হলে তখন আইকাও বাংলাদেশকে অনুমতি দেবে।
বেবিচক ও কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্জিত সমুদ্রসীমা বরাবর আকাশসীমা দিয়ে কত উড়োজাহাজ যাচ্ছে তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশের কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়, যে পরিমাণ এয়ার ক্রাফট যাচ্ছে তা থেকে বাংলাদেশ বছরে ১৫ কোটি টাকার মতো আয় করতে সক্ষম হবে।