‘সম্পত্তি নিয়ে নিন, আমি মাকে চাই’
আমার মাকে চাই। মাকে কেউ এনে দিন আপনারা। আমার মা! আমি র্যাবের কাছে গিয়েছি, পুলিশের কাছে গিয়েছি, ডিসি কার্যালয়ে গিয়েছি, মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে গিয়েছি, থানায় গিয়েছি। সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। মামলা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে তারা তদন্ত করছে। র্যাব, ডিবি পুলিশ জানিয়েছে তারা তদন্ত করছে। কিন্তু আমার মা কোথায়? আজ ১৫ দিন পার হয়ে গেছে মা কোথায়? সবাই কাজ করছে কিন্তু আমার মাকে পাচ্ছে না।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এভাবেই মায়ের সন্ধান চেয়ে আকুতি জানাচ্ছিলেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মরিয়ম মান্নান। খুলনার নিজ বাসার নিচে রাত পৌনে ১১টায় পানি আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন শিক্ষার্থীর মা রহিমা বেগম।
এরপর পরিচিত জনদের কাছ থেকে শুরু করে সর্বত্র খোঁঁজাখুঁজি করেও আর তার সন্ধান মেলেনি। এ সময় কলের পানি আনার বালতি, তার গায়ের ওড়না এবং স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি পরে মামলা হয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তাকে অপহরণ করা হতে পারে বলে ধারণা করছে নিখোঁজ রহিমার পরিবার।
মরিয়ম মান্নান মানবজমিনকে বলেন, যদি আত্মগোপন করে থাকেন তাহলে আমার মা তো আসামি। সবাইকে হেনস্তা করছে। তারা আমার মাকে ধরে আনুক। যারা বলছে মা আত্মগোপন করেছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আমার মাকে জেলে ভরে দিন।
আমি দেখি। তবুও আমার চোখের সামনে দেখতে পাবো যে মা কোথায় আছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মায়ের সঙ্গে মামলা চলছিল। সেই মামলা নিষ্পত্তির পথে। সেখানে আমার মায়ের পক্ষে মামলার রায়।
আমাদের বাড়িতে দিনে দুপুরে এই মামলার আসামিরা ভাঙচুর করে। আমার মা এবং বোনকে মারধর করে। সেই মামলা এখন উচ্চ আদালতে। মামলার রায় আগামী ১৩ই সেপ্টেম্বর হওয়ার কথা রয়েছে। আসামিরা জামিনে।
তাদের নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। আর ২৭শে আগস্ট আমার মা নিখোঁজ হয়েছেন। ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামিরা জামিনে থাকা অবস্থায় আমার মা নিখোঁজ। মাকে খুঁজতে আমি এবং আমার আরও ৫ ভাই-বোন পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আপনাদের কথা মেনে নিয়েছি।
আমার মা আত্মগোপনে আছেন। তাহলে মা’কে খুঁজে দাও তোমরা। গত শুক্রবার খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছি। কিন্তু কেউ আমার মাকে খুঁজে দিচ্ছে না। আজ ঢাকায় এসেছি। একটি অনুরোধ নিয়ে। আমার মাকে খুঁজে দিন।
সন্ধান দিন আমার মা কোথায়? আমি যখন চোখ বন্ধ করি ভাবি গত ১৫ দিন ধরে আমার মা কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন? আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। রাতে ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করতে পারি না।
যে দুটো মামলা চলমান রয়েছে তার মধ্যে একটি মামলা নিষ্পত্তির পথে। আরেকটি মামলার শুনানি ১৩ই সেপ্টেম্বর। মা নিখোঁজ হন ২৭শে আগস্ট। দুটি ঘটনা কি আমাদের ভাবায় না! ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিরা জামিনে রয়েছে। রায় আমাদের পক্ষে। তাহলে মা কেন আত্মগোপনে থাকবেন। তেজগাঁও কলেজের এই শিক্ষার্থী বলেন, পড়ালেখা এবং চাকরির সুবাদে আমরা ৬ ভাই-বোন বিভিন্নস্থানে থাকি।
খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশার হোল্ডিং নম্বর-৩৫ খানাবাড়ির দোতলা ভবনটিতে মা তার বর্তমান স্বামী বিল্লাল হাওলাদারের সঙ্গে ছিলেন। নিখোঁজের পরপরই রহিমা বেগমের মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে ২৮শে আগস্ট দৌলতপুর থানায় মামলা করেন।
মামলা নম্বর- ১৫। এজাহারের বরাত দিয়ে মরিয়ম বলেন, আমার মা রহিমা বেগম ও তার দ্বিতীয় স্বামী মো. বিল্লাল হাওলাদারকে নিয়ে তাদের দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা খানাবাড়ি হোল্ডিং নং-৩৫ এর দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন। গত ২৭শে আগস্ট রাত আনুমানিক পৌনে ১১টায় তাদের মা রহিমা বেগম বাসার নিচে টিউবয়েল থেকে খাবার পানি আনার জন্য বালতি নিয়ে যান।
এরপর রাত আনুমানিক সোয়া ১১টার সময় তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী বিল্লাল হোসেন তাকে দ্বিতীয় তলা থেকে ডাক দেয়। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মায়ের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তখন বাবা বিল্লাল হাওলাদার উপর থেকে নিচে নামেন। কিন্তু মাকে কোথাও দেখতে পায় না। মায়ের আনা বালতিটা টিউবয়েলের নিচে দেখতে পায়।
এ সময় বাবা বিল্লাল হাওলাদার নিচতলার ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মাকে দেখেনি বলে জানায়। তখন তিনি ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির আশপাশে খুঁজতে থাকেন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে টিউবয়েলের সামনে ঝোঁপের মধ্যে আমার মায়ের ব্যবহৃত দুইটি স্যান্ডেল ও ওড়না পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় মাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে আমাদেরকে ফোন দিয়ে পুরো বিষয়টি জানায়।
এ সময় আদুরীসহ তার ভাই সবাই মিলে আত্মীয়দের বাড়িতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মায়ের কোনো সন্ধান মেলেনি। রহিমার ছেলে মো. মিরাজ আল সাদী বাদী হয়ে কেএমপি খুলনার দৌলতপুর থানায় গত ২৮শে আগস্ট মামলা করেন।
এর আগে ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টায় একটি নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করেন তার মেয়ে আদুরী। যার নম্বর-১৪৫৪। জায়গা-জমি নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পূর্ব বিরোধের জেরে রহিমা বেগম বাদী হয়ে প্রতিবেশী মো. মহিউদ্দিন ও তার ভাই গোলাম কিবরিয়া, রফিকুল ইসলাম পলাশ, মো. জুয়েল এবং হেলাল শরীফের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে আদালতে একটি মামলা করেন।
মামলা দায়ের করার পর তাদের মা রহিমা বেগমকে মামলা উঠিয়ে নিতে আসামি হেলাল শরীফসহ অন্যরা মিলে গত ২৬শে জুন হুমকি দেয়। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় চাপ সৃষ্টি করে আসছে।
শিক্ষার্থী মরিয়ম বলেন, এর আগে আমার দুই সৎ ভাই আমাদের প্রতিবেশীদের কাছে ৩ শতাংশ জমি বিক্রি করেন। এরপর থেকেই মাকে আমাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করে আসছিলেন।
এছাড়া মাকে আসামিদের বিরুদ্ধে করা মামলা উঠিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে তাদের কাছে বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য নিয়মিত হুমকি প্রদান করে আসছিলেন। মা কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কিনা আমরা জানি না। আমাদের সম্পত্তির বিনিময়ে হলেও মাকে আমরা ফেরত চাই। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সকলের সাহায্য প্রর্থনা করছি।