পাঁচ বার হাত বদল হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায়

বেকার ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন কুমিল্লার মিলন হোসেন। পূর্ব পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকাপ্রবাসী আল আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে চট্টগ্রামের শফিউল আলম ও ঢাকার পল্টন এলাকার নুর আলমের সঙ্গে দেখা করতে বলেন আল আমীন।

শফিউল ও নুর আলম তার ছেলেকে ৩ লাখ টাকায় দক্ষিণ আফ্রিকা পাঠানোর নিশ্চয়তা দেন। তারপর এক দিন পাসপোর্টসহ ছেলে রিয়াজ হোসেন পাটোয়ারীকে তুলে দেন শফিউল ও নুর আলমের হাতে। তারপর থেকেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ছেলের সঙ্গে। যোগাযোগ বন্ধ করে দেন শফিউল আলম, নুর আলম এবং আল আমিনও।

মাস তিনেক পর হঠাৎ ছেলে রিয়াজ তাকে ফোন করে জানান, আফ্রিকার সীমান্তবর্তী একটি জঙ্গলে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে মানব পাচার ও অপহরণকারীদের আন্তর্জাতিক একটি চক্র। এই চক্রকে ৬ হাজার ডলার না দিলে তাকে মেরে ফেলবে। ব্যবসায়ী মিলন হোসেন বুঝতে পারেন বিদেশে পাঠানোর নামে নিজেই ছেলেকে মানব পাচার ও অপহরণকারী চক্রের হাতে তুলে দিয়েছেন।

ছেলের ফোন পাওয়ার পর অপহরণকারী চক্রের কথামতো আবারও দেখা করেন সেই শফিউল আলমের সঙ্গে। হাতে তুলে দেন ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। টাকা পেয়ে আবারও আত্মগোপনে চলে যান শফিউল। শেষে বাধ্য হয়ে পুলিশের কাছে যান মিলন। গত বছরের ১৩ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ছেলেকে পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেন মিলন হোসেন।

মানব পাচারের এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানতে পারে, পাঁচ বার হাত বদল হয়ে রিয়াজকে পাচার করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। পাচারকারী ও অপহরণকারী চক্র আরও টাকার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তে তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণের টাকা নিয়েছে। পরে ডিবির ডেমরা জোনাল টিম অভিযান চালিয়ে চক্রের দুই সদস্য শফিউল আলম ও রুহুল আমীন চঞ্চলকে গ্রেপ্তার করে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা দৈনিক বাংলাকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে শফিউল ও চঞ্চল জানিয়েছে তারা রিয়াজকে প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই নিয়ে যান। দুবাইয়ে নিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক পাচার ও অপহরণ চক্রের আরেক সদস্য এজাজের হাতে তুলে দেয়া হয়। এজাজ তাকে দুবাই থেকে কেনিয়ার নাইরোবি নিয়ে চক্রের আরেক সদস্যের হাতে তুলে দেয়। তারা নাইরোবি থেকে রিয়াজকে মোজাম্বিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আরেক হাত বদল হয়ে রিয়াজকে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তবর্তী দেশ সোয়াজিল্যান্ড বা ইসোয়াতিনিতে। সেখানে সাঈদ নামে চক্রের আরেক সদস্য তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তে নিয়ে চক্রের আরেক সদস্য পাকিস্তানি নাগরিক আমীরের হাতে তুলে দেয়। আমীর তাকে নিয়ে সীমান্তবর্তী একটি এলাকায় আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন শুরু করে। রিয়াজকে দিয়ে তার বাবাকে ফোন করিয়ে মুক্তিপণের জন্য ৬ হাজার ডলার দাবি করে। আমীরের কথামতো ৬ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চক্রের দেশীয় এজেন্ট শফিউলের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন রিয়াজের বাবা।

ঢাকা মহানগর ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল জানান, দক্ষিণ আফ্রিকায় মানব পাচারের ক্ষেত্রে চক্রটি সাধারণত ঢাকা-দুবাই বা ঢাকা-কাতার রুট ব্যবহার করে। ঢাকা থেকে দুবাই বা কাতার হয়ে কেনিয়া, তানজিনিয়া বা মোজাম্বিকে নেওয়া হয়। কারণ এসব দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে প্রবেশের সুযোগ আছে। শুধুমাত্র কোনো একটি হোটেল বুকিং করতে পারলেই ওইসব দেশে প্রবেশ করা সহজ। সেখান থেকে সড়ক পথে বা নদী পার হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় নেওয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক মানব পাচার ও অপহরণকারী চক্রে বাংলাদেশি নাগরিকেরাই বেশি সম্পৃক্ত। এ ছাড়া স্থানীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসব অপকর্ম করে থাকে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের শেষের দিকে মানব পাচার ও অপহরণকারী চক্রের কবলে থাকা ২৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছিল দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা ফিরতি পথে ইথিওপিয়া গিয়ে আবারও চক্রের হাতে আটকা পড়ে। ইথিওপিয়াতে তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করে অনেকের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে চক্রটি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তারা ওই চক্রের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ আফ্রিকায় মানব পাচারের অসংখ্য ঘটনার একটি রিয়াজ। অনেকেই এই চক্রের কবলে পড়ে আফ্রিকা যাচ্ছেন। চক্রের সদস্যরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের সেখানে পাচার করে।

চক্রটির মূল উদ্দেশ্যই থাকে আফ্রিকার সীমান্তে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করা। ঘটনাস্থল ভিন্ন দেশ হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তাদের সহজেই শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারে না।

তবে আলোচিত এই মামলার তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের একটি যৌথ দল দক্ষিণ আফ্রিকায় যাচ্ছে।

তদন্তে পাঁচ সদস্যের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দল

ঢাকা মহানগর ডিবি কর্মকর্তারা জানান, আলোচিত এই ঘটনায় বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকায়ও মানব পাচার-সংক্রান্ত একটি মামলা হয়েছে। দেশে গ্রেপ্তার আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তদন্ত দলটি দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পাচার ও অপহরণের শিকার রিয়াজের জবানবন্দি গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার (ইন্টারপোল) সহায়তায় আসামিদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেবে।

২২ সেপ্টেম্বর ১০ দিনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন ঢাকা মহানগর ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম (ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে পদায়িত), ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, অতিরিক্ত উপকমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল, তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কামরুজ্জামান ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ।

তদন্ত দলের একজন সদস্য দৈনিক বাংলাকে জানান, তারা এই মামলার তদন্তের পাশাপাশি সেখানে মানব পাচার ও অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় চক্রের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবেন। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় মাদারীপুরের এক বাসিন্দাকে অপহরণ ও হত্যার একটি মামলাও তাদের কাছে তদন্তাধীন আছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে ওই মামলারও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন তারা।

এ ছাড়া সরেজমিনে ভুক্তভোগী, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তারা চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরির চেষ্টা করবেন। এটি করা গেলে দক্ষিণ আফ্রিকায় কেউ মানব পাচার বা অপহরণের শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের দেশীয় এজেন্টদের শনাক্ত করা যাবে। ইন্টারপোল তাদের এই তদন্তে সার্বক্ষণিক সহায়তা করবে।

তদন্ত তদারক দলের সদস্য ও ঢাকা মহানগর ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আমরা দুটি মামলার তদন্তের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছি। সেখানে ভিকটিমের সাক্ষ্য নেয়াসহ ওই দেশে অবস্থান করা আসামিদের বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করব।’

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মানব পাচার মামলায় শাস্তির হার খুবই কম। যদি আমরা ঘটনার মূলে গিয়ে অনুসন্ধান বা তদন্ত করে যথাযথভাবে অভিযোগপত্র দিতে পারি তাহলে পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের পাচারকারীদের মনেও ভয় ঢুকবে যে বাংলাদেশের পুলিশ বিদেশে গিয়ে তদন্ত করছে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পরিসংখ্যান বলছে, মানব পাচারের ঘটনায় দেশে প্রতি মাসে গড়ে অর্ধ শত মামলা হলেও বিচার শেষে সাজা খুবই কম। ২০২১ সালে একটি মামলায় দুজনের সাজা হয়েছে। বর্তমানে মানব পাচার-বিষয়ক প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মামলা আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মানব পাচারের মামলায় অনেক সময় আসামি ও বাদীপক্ষ আপস করে ফেলে। তদন্তেও দুর্বলতা থাকে। এ ছাড়া সাক্ষীরাও আদালতে সাক্ষ্য দিতে চান না। এজন্য আদালতও আসামিদের দণ্ড দিতে পারেন না। এ জন্য মানব পাচারের মামলায় অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তদন্তে প্রয়োজনীয় ও আইনগত সব ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

পাচার-অপহরণের পাশাপাশি খুনেরও শিকার বাংলাদেশিরা

দক্ষিণ আফ্রিকায় মানব পাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের পাশাপাশি খুনের শিকারও হচ্ছেন বাংলাদেশি নাগরিকেরা। প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের অনেক পলাতক সন্ত্রাসী আত্মগোপন করে আছেন। তারা প্রবাসী বাংলাদেশি এবং স্থানীয়দের নিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। মানব পাচারের পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত প্রবাসীদের অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক সংগঠন মুক্ত বাংলার প্রতিষ্ঠাতা শফিকুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘চলতি বছরই দক্ষিণ আফ্রিকায় শতাধিক মানুষ পাচার, অপহরণ ও খুনের শিকার হয়েছেন। প্রবাসী হওয়ার কারণে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তত বেশি গুরুত্বও দেয় না। আর বাংলাদেশের দূতাবাসের এসব নিয়ে আগ্রহ অনেক কম।’

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মাদারীপুরের বাসিন্দা রেজাউল আমান মোল্লা নামে এক প্রবাসীকে পুমালাঙ্গা এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। এর ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের ফান্ডারভেল পার্ক এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়। অপহরণকারী চক্র তাকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ওই ঘটনায় দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ চার বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছিল।

গত ২৬ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের মিচেলসপ্লেন এলাকায় বসবাসরত মাদারীপুরের আক্তার প্রধানকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারী চক্র তাকে নির্মম নির্যাতনের ভিডিও করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ দাবি করে। স্থানীয় প্রবাসীরা সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর মধ্যেই ৮ সেপ্টেম্বর সকালে কুইন্সটাউনের বাসিন্দা মুন্সীগঞ্জের আলামীন নামে এক তরুণকে অপহরণ করা হয়।

প্রবাসীরা জানান, চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা প্রথমে সখ্য গড়ে তুলে টার্গেটের অর্থবিত্ত সম্পর্কে খোঁজ নেয়। পরে চক্রের স্থানীয় সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে অপহরণ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী অধিকারকর্মী এস এইচ মোহাম্মদ মোশারফ বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে যে দেড় লাখ বাংলাদেশি আছেন তার অধিকাংশই অবৈধ পথে আসা। মূলত এরাই অপহরণ বা খুনের শিকার হচ্ছেন। চলতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯১ জন প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন, যার অধিকাংশই ডাকাতের হাতে খুন বা অপহরণের হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব চক্রের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিরাই জড়িত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *