নতুন বলে পুরনো খেলা
দৃশ্যপট একই। কেবল মুখগুলো নতুন। জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে তত স্পষ্ট হচ্ছে পুরনো খেলা। জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ঘিরে এই খেলায় এখন সামনে আসছে নতুন কিছু মুখ।
১৯৯১ সালের পর হওয়া নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টি বরাবরই একই ভূমিকায় ছিল। তারা যেদিকে ঝুঁকেছে ক্ষমতার পাল্লাও সেদিকে কাত হয়েছে। তাই নির্বাচনের আগে দলটিকে নিয়ে যেমন সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ে তেমনি বড় রাজনৈতিক দল দুটি জাপাকে কাছে টানার চেষ্টা করে।
সুবিধা বুঝে জাতীয় পার্টি তার শিবির ঠিক করে। গত দুই জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ঘিরে রাজনৈতিক টানাহেঁচড়া ছিল অনেকটা প্রকাশ্যে। জাপা’র প্রয়াত চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় তার হাতেই ছিল দলটির নিয়ন্ত্রণ।
এ কারণে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিলেও তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। রাজনৈতিক মিত্র বদলের কারণে নানা সময়ে দলটিতে ভাঙন হয়েছে। আসছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির সামনে কঠিন এক চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এই প্রথম কোনো জাতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে দলটি।
সংসদের বিরোধী দলে থাকা দলটি এখনো জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো অবস্থান স্পষ্ট করেনি। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার বক্তব্য এবং বিবৃতিতে যেসব কথা বলছেন তাতে সরকারের অনেক সমালোচনা থাকছে।
এতে অনেকে ধারণা করছেন, দলটি আগামী নির্বাচনে অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও নজরে রাখা হয়েছে দলটির গতিবিধি। এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরনো খেলাই আবার দেখা যাচ্ছে। এখানে শুধু খেলোয়াড় নতুন। তবে এই খেলার ফল কী হবে তা এখনই হয়তো চূড়ান্ত করা যাবে না।
আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও অধিকাংশ সিনিয়র নেতাদের অবস্থানে এটা স্পষ্ট যে, এবার নতুন রাজনৈতিক কৌশলেই এগোচ্ছে জাপা। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে জিএম কাদেরের একটি সাক্ষাৎকে নতুন কোনো ইঙ্গিত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আর এমন কোনো ইঙ্গিতের কারণেই দলের ভেতরে নতুন টানাপড়েন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল তা অবশ্য অনেকটা মিটে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করে এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করা হয়। দলের চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের। রওশনকে করা হয় দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
যদিও দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এটি অলংকারিক পদ। অনেকে বলছেন, জিএম কাদের নিজস্ব দক্ষতায় দলের নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে নিয়েছেন। রওশন এরশাদ ও তার অনুসারী নেতাদের এখন আর তেমন অবস্থান নেই।
এ অবস্থায় সামনের নির্বাচনেও তারা বড় কোনো ভূমিকা নিতে পারবেন না। জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন দলীয় ফোরাম গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিষয়টি আঁচ করেই তার বিরোধী পক্ষ তৎপর হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা রওশন এরশাদকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন। তৎপরতার অংশ হিসেবেই গত ৩০শে আগস্ট হঠাৎ করেই পার্টির জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন এরশাদ। দলের নেতারা বলছেন, প্রধান পৃষ্ঠপোষক একটি সম্মানের পদ।
তিনি কাউন্সিল ঘোষণার এখতিয়ার রাখেন না। তাকে কেউ চাপ প্রয়োগ করে এই কাউন্সিলের উদ্যোগ নিয়েছে। রওশন এরশাদের মাধ্যমে কাউন্সিল ডাকার পরই দলীয় ফোরামের বিরুদ্ধে কিছু একটা হতে যাচ্ছে- এমন বিষয় আঁচ করতে পেরে দলীয় সংসদ সদস্যদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।
ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার আসন থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে দেয়ার। কারণ হিসেবে তারা সামনে আনেন রওশন এরশাদের অসুস্থতা। পরে দলীয় ২৬ এমপি’র মধ্যে ২৪ জনের সমর্থন নিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা করতে স্পিকার বরাবর চিঠি দেয়া হয়। স্পিকারের দপ্তর সূত্র বলছে, এই চিঠির বিষয়ে আপাতত ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
আগামী সংসদ অধিবেশনের আগে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নাও আসতে পারে। এর মধ্যে পাল্টাপাল্টি খেলায় দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে। তখন হয়তো এই চিঠি কার্যকারিতাও হারাতে পারে। জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, নানা কারণে এখন তারা শঙ্কিত। দলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে দলের কতিপয় নেতা জড়িত। যদিও তাদের কোনো ধরনের জনসম্পৃক্ততা নেই।
এমন অবস্থায় সামনে করণীয় ঠিক করতে চ্যালেঞ্জে পড়তে পারেন দলীয় চেয়ারম্যান। পরিস্থিতি যাই হোক আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তিনি জন ও কর্মীবান্ধব সিদ্ধান্ত নেবেন বলেই তারা আশা করছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু অবশ্য মানবজমিনকে বলেন, দলবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তারা অবগত। তবে এসব নিয়ে তারা খুব একটা ভাবছেন না। আপাতত আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া ও তৃণমূলে দল গোছানোর লক্ষ্য নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এখন ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করতে ৩২টি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে এই টিমগুলোকে কার্যক্রম শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জাতীয় পার্টি কোনো বড় জোটে যোগ দেবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়াই এখন পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত, পরবর্তীতে কী হবে তা নির্বাচনী সময়ের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বক্তব্যও অভিন্ন। তিনিও জানিয়েছেন, জোট এবং ভোটের বিষয়ে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি কী হবে সেটা হয়তো এখনই আঁচ করা যাচ্ছে না।
রওশন এরশাদের সম্মেলন ডাকার পর দলীয় এমপিদের পক্ষ থেকে রওশন এরশাদকে সরাতে চিঠি পাঠানোর সময়ে জিএম কাদেরের মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনাকে অনেকে ভিন্নভাবে দেখছেন। ঘটনার ৯ দিন পর ফোনটি উদ্ধার হলেও অনেকে বলছেন, এটি স্রেফ ছিনতাইয়ের ঘটনা নাও হতে পারে।
এর সঙ্গে পার্টির চলমান ঘটনাপ্রবাহকে মিলিয়ে দেখছেন কেউ কেউ। কাছাকাছি সময়ে জিএম কাদেরের গাড়ি দুর্ঘটনার ঘটনাটিকেও মিলিয়ে দেখছেন অনেকে। দুর্ঘটনায় জিএম কাদেরের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি নিজেও আহত হয়। দু’টি ঘটনা একই এলাকায় ঘটেছে।
এ ছাড়া রওশন এরশাদকে সরিয়ে দেয়ার চিঠির পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় সংসদের উপনেতার আসন থেকে জিএম কাদেরকে সরিয়ে দিতে চিঠি দেয়া হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে। জিএম কাদেরকে সরিয়ে সিনিয়র সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদকে এ পদ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
এ সংক্রান্ত একটি চিঠির ড্রাফটও মানবজমিনের হাতে এসেছে। যদিও এ চিঠি দেয়া হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই গত ৫ই আগস্ট জিএম কাদেরকে মোবাইলে জীবননাশের হুমকি সংবলিত একাধিক বার্তা পাঠান কাজী মামুনুর রশীদ। বিদিশা সিদ্দিকের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে গঠিত ট্রাস্টের কর্মকর্তা এই মামুনুর রশীদ।
জিএম কাদেরকে তিনি বরইগাছের পাতার ছবি ও কবরের ছবি পাঠান। এ ঘটনার পর ৭ই আগস্ট জিএম কাদেরের জীবননাশের হুমকির কথা জানিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন বিরোধীদলীয় উপনেতার সহকারী একান্ত সচিব মো. আবু তৈয়ব। কাজী মামুনুর রশিদ এক সময় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর গঠিত এরশাদ ট্রাস্টের তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন।
ওদিকে জিএম কাদেরের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এখন কথা বলছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। দলের মধ্যে ভিন্ন তৎপরতায় নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন তিনি। সরকারের সুদৃষ্টিতে থাকায় তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।
রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে তিনি দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন। ওই নেতারা এখন জিএম কাদেরপন্থি নেতাদের সন্দেহের তালিকায় আছেন। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে রওশন এরশাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।
ওই নির্বাচন থেকে এরশাদও শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু রওশন এরশাদ শেষ পর্যন্ত তার অনুসারীদের নিয়ে নির্বাচনে থাকেন এবং ওই নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হয় সেই সংসদে রওশন এরশাদই বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।
সেই নির্বাচনে জিএম কাদের অংশগ্রহণ করেননি। আসন্ন নির্বাচনের আগে আবারো এমন কোনো ঘটনার অবতারণা হতে পারে বলে দলের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। এমনও হতে পারে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে রওশনপন্থি নেতারা এর বিপরীত অবস্থান নিয়ে প্রেক্ষাপট জটিল করে তুলতে পারেন।