বাসায় ফেরার পর র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নিলয়কে
কথিত হিজরতের পর বাসায় ফিরে এসেছিলেন কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া সাত তরুণের একজন সারতাজ ইসলাম নিলয়। বাসায় ফেরার পর পরিবারের সদস্যরাই বিষয়টি জানিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এর দুই ঘণ্টার মধ্যে ১৫-১৬ জন ব্যক্তি সাদা পোশাকে নিজেদের র্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে তাকে বাসা থেকে নিয়ে যান। কিন্তু এরপর থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছেন না স্বজনরা।
স্বজনদের দাবি, নিলয় ভুল বুঝতে পেরে নিজেই বাসায় ফিরে আসেন। বিষয়টি তারা স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানান। এখন ১২ দিন ধরে তারা আর নিলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখা করতে পারছেন না। একাধিকবার র্যাব সদর দপ্তরে গিয়েও নিলয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তবে র্যাবও নিলয়কে হেফাজতে নেয়ার কথা স্বীকার করেনি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া সাতজনকে আমরা খুঁজছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। এই সাতজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে— এমন আরও চার কিশোরও বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমরা সেই চার কিশোরকে পরিবারের সদস্যদের সামনে রেখে কাউন্সেলিং করেছি। তাদের পরিবারের কাছে ফেরতও দিয়েছি।’
গত ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে একজন ও কুমিল্লা থেকে ছয়জনসহ মোট সাত তরুণ একযোগে বাসা থেকে নিখোঁজ হন। প্রাথমিক তদন্ত শেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানতে পারেন, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে কথিত হিজরতের নামে তারা ঘর ছেড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের খোঁজে মাঠে নামেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিলয় ছাড়া বাকি তরুণদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
সারতাজ ইসলাম নিলয়ের ফুফু আকলিমা আক্তার জানান, নিলয় পরিবারের সঙ্গে কল্যাণপুরের ১১ নম্বর সড়কের একটি বাসায় থাকতেন। তিনি সম্প্রতি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। দুই মাস আগে মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়েও হয়। গত ২৩ আগস্ট সকালে তিনি ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি বসুন্ধরা এলাকায় যাচ্ছেন বলে জানান।
আকলিমা আক্তার জানান, রাতেও নিলয় বাসায় ফিরে না আসায় খোঁজাখুঁজি করে জানা যায়, নিলয়ের সঙ্গে তার খালাতো ভাই নেহাল আব্দুল্লাহও কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ। কুমিল্লায় নেহাল আব্দুল্লাহর বাবা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে নিলয়ের মা লাভলী ইয়াসমীন গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর থানায়একটি জিডি করেন।
নিলয়ের মামাতো বোন ফাতেমা-তুজ-জোহরা জানান, ২৯ আগস্ট হঠাৎ নিলয় তার স্ত্রীর মেসেঞ্জারে একটি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি বাড়িতে ফিরতে চান বলে জানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানান। ৩১ আগস্ট সকাল ৭টার দিকে নিলয় নিজেই কল্যাণপুরের বাসায় হাজির হন।
ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, নিলয় বাসায় আসার পর তাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বাসায় এসে তিনি যখন জানতে পারেন পুরো বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে তোলপাড় চলছে, তখন তিনি অনেকটা ভয় পেয়ে যান। ভয়ে আবার বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে পরিবারের সদস্যরা তাকে ঘরে আটকে রাখেন। নিলয় বাসায় ফেরার পরপরই তার খালু ও নিখোঁজ নেহাল আব্দুল্লাহর বাবা বিষয়টি কুমিল্লার র্যাব কর্মকর্তাদের জানান। এর দুই ঘণ্টার মধ্যেই র্যাব পরিচয়ে ১৫-১৬ জনের একদল লোক তাদের বাসায় আসেন।
আকলিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা নিজেরাই নিলয়ের বাসায় ফেরার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালাম। এখন আমরাই নিলয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। নিলয়কে নিয়ে যাওয়ার এক দিন পর বছিলায় র্যাব-২-এর অফিসে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাাদের র্যাব হেডকোয়ার্টারে যেতে বলা হয়। র্যাব হেডকোয়ার্টারে একাধিকবার গেলেও নিলয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। শুধু একজন লোক এসে বলেছেন, নিলয় ভালো আছে।’
আকলিমা আক্তার বলেন, ‘নিলয় তো স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছে। ও তো দেশের এমন কোনো ক্ষতিও করেনি। যদি ওকে কাউন্সেলিং করাতে হয়, তাহলে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিক। আর যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, তাহলে আদালতে সোপর্দ করুক। আমরা তো মহাদুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছি।’
ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ‘র্যাব পরিচয়ে যারা বাসায় এসেছিল, তাদের একজন একটা মোবাইল নম্বর দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ফোন করলে তিনি ফোন ধরেন না। ফোন ধরলেও নিলয়ের বিষয়ে কোনো কিছু বলেন না। এটা তো কোনো সিস্টেম হলো না।’
বরিশালে এক হুজুরের মাদ্রাসায় ছিলেন নিলয়
বাসায় ফেরার পর নিলয় তার স্বজনদের জানিয়েছেন, যাদের ডাকে তারা সাতজন ঘর ছেড়েছিলেন, এক দিন পরেই প্রত্যেককে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। নিলয় জানান, তাকে চাঁদপুর থেকে বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। বরিশালে তিনি এক হুজুরের মাদ্রাসায় ছিলেন। যাওয়ার পর কথিত সেই বড় ভাইয়েরা তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও ব্যাগও নিয়ে নিয়েছেন। ৩০ আগস্ট রাতে তিনি ওই মাদ্রাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে লঞ্চে করে সদরঘাটে নেমেছেন বলে নিলয় পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন।
স্বজনরা জানান, কাদের কথায় নিলয়সহ অন্যরা ঘর ছেড়েছিলেন— এ কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। যাওয়ার আগে নিলয় তার ল্যাপটপ ও আইফোন বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি এগুলো বিক্রি করে নতুন ল্যাপটপ ও একটি ফোন কিনবেন। সে সময় স্বজনরা ঘুণাক্ষরেও বিষয়টি টের পাননি।