ফুঁসছে কৃষক

দেশের বিভিন্ন জেলায় চাহিদামতো সার না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন কৃষক। কোথাও কোথাও কৃষকের সার না পাওয়ার কষ্ট দৃশ্যমান। বিক্ষুব্ধ কৃষকরা সারের দাবিতে রাস্তায় নামছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জেলার ডিলারদের কাছ থেকে সারের অতিরিক্ত বরাদ্দের চাহিদাপত্র আসছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এরপরও কৃষিমন্ত্রী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলছেন, দেশে সারের কোনো সংকট নেই। তাহলে কৃষক পর্যায়ে পর্যাপ্ত সার না পাওয়ার হাহাকার কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, পরিবহণ পর্যায়ে ঘাপলা, সার বেচাকেনায় আইনি বেড়াজালে ডিলারদের আটকে রাখা এবং কারখানাকেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের লোভের আগুনে পুড়ছে কৃষক।

এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসাবে আলোচনায় খোদ সরকার দলের সাবেক সংসদ-সদস্য ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল আশরাফ খান পোটন। বুধবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের এক অনলাইন বৈঠকে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাও। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল আশরাফ খান পোটন যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশে সারের কোনো ঘাটতি নেই এটা ঠিক। অনেক জায়গায় চাহিদার চেয়ে কম বরাদ্দ দেওয়ায় সংকট দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত চাহিদাপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের সার পৌঁচ্ছে দিচ্ছি। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এই সংকট কেটে যাবে। সংকটের আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা জেলায় সারের চাহিদা তেমন নেই। এরপরও পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগে এই বরাদ্দের বেশির ভাগ সার মিলগেটে বিক্রি হয়ে যেত।

যেসব জেলায় চাহিদা বেশি, সেখানকার ডিলাররা কিনে নিত। এবার কড়াকড়ি আরোপ করায় মিলগেটে এগুলো বিক্রি হচ্ছে না। ফলে কোথাও সার বাড়তি থাকছে। কোথাও সংকট হচ্ছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘দেশে আমার কোনো সারের ব্যবসা নেই। ডিলারশিপের কোনো লাইসেন্সও নেই। আগে আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিতাম। এখন জিটুজির মাধ্যমে সার আমদানি হওয়ায় সেটাও বন্ধ।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্যারিয়ার আমি একা নই। অনেকেই আছে। তেলের দাম বাড়ার পর সার পরিবহণের খরচ সমন্বয় না করায় অনেকেই চলে গেছে। আমি ইজ্জতের কথা ভেবে প্রতিদিন সার সরবরাহ করে যাচ্ছি।’

সার সংকট ও বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) মো. আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘কোথাও কোথাও দাম বাড়ার গুজবে কৃষক বেশি পরিমাণ সার কিনে মজুত করছে। আসলে সারের কোনো সংকট নেই। সেপ্টেম্বর মাসের সার অগ্রিম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সার মজুত ও বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করছে। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উপসহকারী কৃষি অফিসাররা ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের গুদামে উপস্থিত থেকে সার বিক্রির তদারকি করছেন।’

কৃষি অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ৬৪ জেলার কৃষকদের চাহিদা মেটাতে ভর্তুকি মূল্যে ২৫ লাখ ৮০ হাজার টন ইউরিয়া, ৬ লাখ ৮৫ হাজার টন টিএসপি, ১৬ লাখ ৩০ হাজার টন ডিএপি, ৭ লাখ ৩৫ হাজার টন এমওপি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও প্রায় সমপরিমাণ সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় গত অর্থবছরের তুলনায় এবার এমওপি সারের বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। বরাদ্দ দেওয়া সার দেশে মজুতও আছে। কিন্তু পরিবহণে ঘাপলা ও ডিলার পর্যায়ে বেচাকেনায় বিধিনিষেধের কারণেই মূলত কৃষক পর্যায়ে সারের সংকট তৈরি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জিটুজির মাধ্যমে দেশে সার আমদানি করে সরকার। আমদানি করা সার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের পর তা পরিবহণ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস করপোরেশনের (বিসিআইসি) নির্দিষ্ট বাফার গুদামে পৌঁচ্ছে দেওয়ার কাজ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা। আর এসব ঠিকাদারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মেসার্স পোটন ট্রেডার্স, দেশ ট্রেডিং ও কৃষ্টিয়া ট্রেডিং। এরা মূলত বিএডিসি ও বিসিআইসি থেকে বরাদ্দ নিয়ে সাব-ঠিকাদারদের দিয়ে সার পরিবহণের কাজ করিয়ে থাকে।

১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ ১ কোটি ৬৯ লাখ টন সার পরিবহণের কাজ করেছে মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। এখনো বরাদ্দের ৪৮ হাজার টন এমওপি এবং ৮০ হাজার টন ইউরিয়া সরকারি বাফার গুদামগুলোয় সরবরাহ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কৃষকের জরুরি চাহিদা মেটাতে ডিলারদের সার সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সরবরাহ পর্যায়ে এই ঘাপলার কারণেই বিভিন্ন জেলার ডিলাররা জুলাই ও আগস্টে তাদের বরাদ্দের সার তুলতে পারেনি। এই ফাঁকেই সার না পেয়ে কয়েকটি জেলায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে কৃষক। অথচ চট্টগ্রাম, বাঘাবাড়ী, নগরবাড়ি, নোয়াপাড়া, আশুগঞ্জ, খুলনার শিরোমণিসহ বড় মোকামগুলোয় পর্যাপ্ত সারের মজুত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিএডিসি ও বিসিআইসি তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের সময়মতো সার পরিবহণে বাধ্য না করার কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ আছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটির অসৎ কিছু কর্মকর্তাদের সখ্য থাকার কারণে ঠিকাদাররা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, সরবরাহ ঘাপলার কারণে সংকটের পাশাপাশি খুচরা পর্যায়ে সরকারি মূল্যের চেয়ে বাড়তি দামে সার বেচাকেনার পেছনেও রয়েছে একাধিক কারণ। যার অন্যতম হচ্ছে, কারখানা গেটে ডিলারদের সরকারি বরাদ্দ কেনাবেচায় সিন্ডিকেটের তৎপরতা, পরিবহণ সিন্ডিকেটের আধিপত্য ও ডিলারদের পরিবহণ ভাড়া সমন্বয় না করা। এই সিন্ডিকেটের নেপথ্যেও কামরুল আশরাফ খান পোটনের একক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আছে। তার সিন্ডিকেটভুক্ত সদস্যরা কারখানা গেট থেকে যেসব এলাকায় ডিলারদের সারের চাহিদা কম তাদের চাহিদাপত্র কিনে রাখেন।

এরপর সুযোগ বুঝে যেসব জেলায় সারের চাহিদা বেশি, সেসব জেলার ডিলারদের কাছে বেশি মূল্যে বিক্রি করে দেন। এই সার তুলে এলাকায় নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয় ডিলাররা। আবার ডিলার পর্যায়ে কারখানা এবং গুদাম থেকে সার তুলতে গেলেও বাড়তি টাকা গুনতে হয়। একজন ডিলার জানান, সরকারি বরাদ্দপত্র থাকার পরও সিন্ডিকেট ছাড়া কারখানা ও গুদাম থেকে সার বের করে নেওয়া ডিলারদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার গুদামের ইনচার্জ ও স্টোরকিপারদের টাকা দেওয়া ছাড়া নির্ধারিত সার পান না ডিলাররা। বরাদ্দপত্রে কালো টিএসপি দেওয়ার কথা থাকলেও বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা গুদাম ইনচার্জকে না দিলে ডিলারকে সাদা টিএসপি ধরিয়ে দেওয়া হয়। কৃষক পর্যায়ে সাদা টিএসপির চেয়ে কালো টিএসপির চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় ডিলারও ঘুস দিতে বাধ্য হয়।

বিএডিসি ও বিসিআইসির যেসব কর্মকর্তা বাফার গুদামের ইনচার্জ ও স্টোরকিপারের দায়িত্ব পালন করেন, তারা এই অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত। এছাড়াও ১৩ বছর আগের পরিবহণ ভাড়ার ওপর ভিত্তি করে ডিলার পর্যায়ে সারের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তিন দফা তেলের দাম বাড়ার পরও তা সমন্বয় করা হয়নি। ফলে ডিলাররা সার তুলে বিক্রির চেয়ে কারখানাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের কাছে ডিও বিক্রিতে বেশি আগ্রহী। যার সরাসরি প্রভাব পরে কৃষক পর্যায়ে। ডিলার পর্যায়ে কথা বলে সার সংকটের আরও একটি কারণ জানা গেছে, তা হচ্ছে সার বেচাকেনায় বিধিনিষেধ। এক উপজেলার কৃষক বা খুচরা বিক্রেতারা অন্য উপজেলার ডিলারের কাছ থেকে সার কিনতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সংকট স্থানীয়ভাবে মোকাবিলা করাও সম্ভব হয় না। কাজেই সার বিক্রিতে স্থানীয় বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলে এই সংকটের সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *