দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা কপাল পুড়লো পঙ্কজের

দুর্নীতির অভিযোগ। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়া। স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন। দলীয় প্রতিপক্ষের পর তার সমর্থকদের ওপর হামলাসহ নানা কারণে এসেছেন খবরের শিরোনামে। আলোচনা-বিতর্কে থাকা বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথকে দলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। হঠাৎ প্রভাবশালী এই এমপিকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়ায় চলছে নানা আলোচনা।

তবে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কারের কারণ হিসেবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের কথা বলা হয়েছে। দলের সব ধরনের পদ থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেউ কোনো মন্তব্য করেননি। এ প্রসঙ্গে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সাধারণ সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আসলে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গতকাল পঙ্কজ দেবনাথকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। গতকাল দুপুরে চিঠিটি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুসের কাছে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। এ বিষয়ে এই মুহূর্তে বেশি কিছু বলার নেই। চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে আওয়ামী লীগের বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ অন্যান্য পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ। উপরিউক্ত বিষয়ে আপনার লিখিত জবাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দপ্তর বিভাগে জমা দেয়ার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।

যে কারণে পতন: পঙ্কজ দেবনাথকে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা মনে করে হতো। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরই তিনি তার প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করতে থাকেন। এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, তিনি দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ’র নির্দেশও মানতেন না। হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জে তিনি নিজেই আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করতেন। এভাবে তিনি উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করে দিতেন। আধিপত্য বিস্তারে তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে গত এক মাসে তার কর্মীদের হাতে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সেক্রেটারির দু’পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়, হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসারত আওয়ামী লীগ কর্মীদের বেধড়ক কোপানো হয়। সহিংসতায় খুন হয় দু’জন কর্মী। আহতরা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না পেরে পালিয়ে বরিশাল এসে চিকিৎসা নিয়েছেন।

বছর চারেক আগে এক অডিও ফাঁসে পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে সমালোচনা আরও জোরালো হয়। বিরোধী দলীয় নেতাদের নামে যে গাড়ি পোড়ানো মামলা ছিল, সেগুলো সাজানো, তার নিজের পরিবহনের গাড়ি নিজে পুড়িয়ে মামলা দেয়ার চাঞ্চল্যকর অডিও শুনে পুরো দেশবাসী হতবাক হয়।

প্রতিটি উপজেলা, ইউপি নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসাবে পঙ্কজ দেবনাথের বিদ্রোহকে চিহ্নিত করা হয়। সম্প্রতি ৯টি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে।

হিজলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, হিজলা আওয়ামী লীগের সদস্য এডভোকেট মুনসুর আহমেদ। মানবজমিনকে তিনি জানান, সে নির্বাচনে তিনি ঘর থেকেই বের হতে পারেননি। তার কর্মীরা ছিল সব পালিয়ে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবার পরও তিনি হেরেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের প্রার্থীর কাছে।

তিনি জানান, শুধু নির্বাচনের সময়ই নয়, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪ জন নিহত হয় পঙ্কজ বাহিনীর হাতে। এরমধ্যে মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ায় ৩ জন। আগস্ট মাসে পঙ্কজ বাহিনী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন মণ্ডলের দু পায়ের রগ কেটে দেয়। এ হামলায় আহত নেতাকর্মীরা মেহেন্দিগঞ্জ স্বাস্থ্য ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গেলে হাসপাতালে ঢুকে আহত কর্মীদের আরেক দফা কোপানো হয়।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। তবে সে সময়ে পঙ্কজ দেবনাথ এটিকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন। সবশেষ চলতি বছরের ২০শে জুলাই আরেকটি অডিও ফাঁস হয়। সেখানে ওসির সঙ্গে তার বক্তব্য ছিল- মেয়রকে সামনে পেলে তাকেও কোপানো হবে। পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান ছিলেন আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ’র অনুসারী এবং পঙ্কজ দেবনাথের ঘোর বিরোধী। ১২ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে আলোচিত ক্যাসিনোকাণ্ডেও তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ওই সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম থেকে মোল্লা আবু কাওছার এবং পঙ্কজ দেবনাথকে বাদ দেয়া হয়। পরে তাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। অঢেল সম্পদ অর্জনেরও অভিযোগ রয়েছে পঙ্কজের বিরুদ্ধে। এদিকে পঙ্কজ দেবনাথের দল থেকে বহিষ্কারের সংবাদে দুপুর থেকে হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, কাজিরহাট এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। চলে আনন্দ মিছিলও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *