‘জাপার দুর্গে’ ফাটলের সুযোগ নিতে চায় আওয়ামী লীগ

বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা ইস্যুতে রংপুর জাতীয় পার্টি (জাপা) এখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, কুশপুত্তলিকা দাহসহ উত্তেজনা চলছে ‘জাতীয় পার্টির দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে। এ অবস্থায় আসছে ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপার প্রার্থিতা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। দলের অনেক নেতা-কর্মীই এই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।

এদিকে, রংপুর সিটিতে প্রথমবার জয় পেলেও দ্বিতীয়বার জাপা প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। সিটির তৃতীয় নির্বাচনে ফের মেয়র পদে জিততে মরিয়া ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এখন জাপায় বিভক্তি দেখা দেয়ায় এটিকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

রংপুর সিটিতে তৃতীয়বারের মতো ভোট হতে পারে আগামী ডিসেম্বরে। ২০১২ সালের সিটির প্রথম ভোটে জয় পান আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। দ্বিতীয় ভোটে অবশ্য জাপা প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে প্রায় এক লাখ ভোটে হেরে যান তিনি। তবে আওয়ামী লীগ এবার আর কোনোভাবেই সিটি মেয়র পদটি হারাতে চায় না। জাতীয় পার্টির বিভক্তি তাই এই সিটি নির্বাচনের সমীকরণ বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিকরা।

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত বুধবার দলের রংপুর মহানগরী কমিটির সভাপতি ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ নিয়ে বুধবার বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রংপুর নগরীতে রাঙ্গাপন্থি আর জিএম কাদেরপন্থিদের মধ্যে ছিল উত্তেজনা। পক্ষে-বিপক্ষে মিছিলও হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যায় জিএম কাদেরের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন রাঙ্গাপন্থিরা। পরে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা সাবেক মহাসচিব ও সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত মসিউর রহমান রাঙ্গারও কুশপুত্তলিকায় আগুন দিয়েছেন কাদেরপন্থিরা। সেখানে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন রংপুরের সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। অন্যদিকে, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রংপুর নগরীর গুপ্তপাড়া থেকে মোটর মালিক সমিতির নেতা ও জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এতে মোটর মালিক ও শ্রমিক ছাড়াও জাতীয় পার্টির রাঙ্গাপন্থিদের একাংশ অংশ নেয়।

রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি ও মোটর মালিক সমিতির নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলে ফিরিয়ে নিতে হবে। তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তার অব্যাহতি আমরা মানছি না। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে রাঙ্গাকে দলে বহাল করতে হবে।’

তবে সিটি মেয়র ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যানকে রংপুরে রাজনীতি করতে দেবেন না বলে রাঙ্গা গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ঠিক হয়নি। রাঙ্গা সম্পর্কে পার্টির চেয়ারম্যান বহিষ্কারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সঠিক ও সময়োপযোগী। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে রংপুর মহানগর ও জেলা কমিটি থাকবে।’

দুই নেতাকে ঘিরে এমন মুখোমুখি অবস্থানকে দলের জন্য নেতিবাচক হিসেবেই মনে করছেন জাপার নেতা-কর্মীদের অনেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপার একজন নেতা বলেন, ‘সামনে সিটি নির্বাচন। এমন সময় বড় দুই নেতার বিরোধ আমাদের অনেককেই আহত করেছে। কার পক্ষে কে যাবে, সেটা এখন বলা কঠিন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ বহু দিন ধরে ওত পেতে আছে এই আসন এবং মেয়র পদটি নিতে। এ অবস্থায় জাপার দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে এমন বিরোধ আওয়ামী লীগের পথ সুগম করবে। জাপা কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সুযোগ নেবে। জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে এই দুই নেতার এক থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’

জাপা নেতারা সরাসরি স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ নেতারা জাপার এই বিভক্তিকে রংপুর সিটি নির্বাচনের জন্য বড় কোনো নিয়ামক হিসেবে দেখাতে চান না। তারা বলছেন, রংপুরে জাপার সংসদ সদস্য থাকলেও উন্নয়নের নেপথ্যে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তাই সিটি নির্বাচনেও ভোটাররা নৌকার প্রার্থীকে বেছে নেবে।

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, ‘রংপুর কারো দুর্গ নয়। এখানকার মানুষ বুঝে গেছে, নৌকা ছাড়া উন্নয়নের বিকল্প নেই। সুতরাং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীর বিজয় হবে- এটা নিশ্চিত।’

জাপার বিভক্তি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শাফিয়ার রহমান শফি বলেন, ‘তাদের এই দ্বন্দ্ব হোক আর যা-ই হোক, এটা নিয়ে আমরা ভাবি না। রংপুর সিটির মানুষ উন্নয়ন দেখতে চায়। এ কারণে নৌকার প্রার্থী প্রায়োজন।’

অবশ্য দলীয় বিভক্তি ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘রাঙ্গাবিরোধিতার বিন্দুমাত্র প্রভাব ভোটে পড়বে না। আর অন্যায়ভাবে কেউ দলের ভোট নিতে চাইলে সেটিও পারবে না। ১৯৩টি কেন্দ্রে আমাদের প্রহরী রয়েছে।’

সিটি মেয়র বা আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু। তিনি বলেন, ‘বুধবার রংপুরের মানুষ যে দৃশ্য দেখেছে, তা বিস্ময়কর। দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে এমন বিরোধ দেখা দিলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়বেই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *