জাতীয় পার্টির অশান্তির নেপথ্যে: জোটের রাজনীতিতে কদর বাড়াতে নতুন কৌশল

জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক গৃহদাহের পেছনে দলের নীতিনির্ধারকদের ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতির কৌশল হিসেবে ভাবছেন দলটির নেতা-কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আগামী নির্বাচনে দলটির ভূমিকা কী হবে সেটা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে দেবর জি এম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদের মধ্যে মতভেদ সাম্প্রতিক অশান্তির কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

গত কিছু দিন যাবত দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কণ্ঠে সরকারের সমালোচনা প্রকটভাবে শোনা যায়। অনেকে মনে করছেন, জোট আর ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের কদর বাড়াতেই তারা সরকারবিরোধী ভূমিকা নিচ্ছেন।

অন্যদিকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ অনেকটাই সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। জি এম কাদেরসহ সরকারবিরোধী অংশের তৎপরতা ঠেকাতে অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন হঠাৎই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের দলগুলোতে স্বার্থের দ্বন্দ্বই প্রকট থাকে। মূলত নিজেদের স্বার্থ ঠিক রাখতেই দলের ভেতর এই জটিলতা।’

রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয়া এরশাদ দেশ শাসন করেছেন ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

রাষ্ট্রপতি থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পরও আমৃত্যু নির্বাচনী রাজনীতিতে অনেকটা শক্ত অবস্থান নিয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। রাজনীতির নানা মেরুকরণে তার জীবদ্দশাতেই জাতীয় পার্টি ভেঙেছে ৯ বার। দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান ও এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, নতুন করে আবারও ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে দলটি। তবে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যখন আমাদের চেয়ারম্যান জি এম কাদের জাতীয় পার্টির রাজনীতির কৌশল পরিষ্কার করছেন, যখন তিনি বলছেন, আমরা এখন আর কোন জোটে নেই, জাতীয় পার্টি কারও দালালি করবে না, তখন হয়তো কারও কারও কষ্ট হতে পারে।

চুন্নু বলেন, যারা দালালি করতে চায় তারা কখনোই সফল হবে না। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি থেকে দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়।

জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, ৯০ সালের পর এত বড় সংকটে কখনো পড়তে হয়নি দলটিকে। ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের যেমন প্রভাব ছিল, তেমনি দলও ছিল চেয়ারম্যানের একক নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি নতুন সংকটে পড়ে। সেবার এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের পর রওশন এরশাদ হন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা।

সেই সুবাদেই জাতীয় পার্টিতে একক নিয়ন্ত্রণ হারান দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এতে জাতীয় পার্টি যেমন সাধারণ মানুষের কাছে ইমেজ সংকটে পড়েছে তেমনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়েছেন হাস্যরসের পাত্র। তাই জাতীয় পার্টির হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার ও দলে চেয়ারম্যানের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন জি এম কাদের।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, জি এম কাদেরের উদ্যোগে পার্টির সরকারঘেঁষা অংশটি পড়েছে বেকায়দায়। ওই অংশটি এরশাদের নেতৃত্ব অস্বীকার করে রওশনের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হওয়ায় তারাই সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ওই অংশটিই আবার ভর করেছে অসুস্থ রওশনের ওপর।

রওশন এরশাদ-জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব পুরোনো। এরশাদ তার মৃত্যুর আগে সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যান। গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করে একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেন এরশাদ। তবে ওই সময়ে রওশনপন্থিদের অভিযোগ ছিল, অসুস্থ এরশাদকে ব্ল্যাকমেইল করে ওই স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে।

এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির দ্বিধাবিভক্ত কমিটি ঘোষণা হয়। ওই সময় জি এম কাদেরপন্থিদের দাবি ছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দুটি পদই পাবেন জি এম কাদের। তবে ঐক্যের স্বার্থে বৈঠকে বসেন ভাবি আর দেবর। জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধীদলীয় নেতার পদ রওশনকে দিয়ে সমঝোতা হয় দুজনের। পার্টির চেয়ারম্যান পদে থেকে যান জি এম কাদের।

এরশাদের সময় থেকে জি এম কাদের পর্যন্ত দলটির মহাসচিব পরিবর্তন করা হয় বারবার। সাবেক মহাসচিবদের নেতৃত্বে কয়েকটি উপদল সক্রিয় রয়েছে নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য। আর জি এম কাদের চেয়ারম্যান হওয়ায় অনেক নেতাই পড়ে গেছেন সাইডলাইনে। রওশন এরশাদকে কেন্দ্র করে জি এম কাদেরের সঙ্গে দরকষাকষি করতে চান ওই নেতারা।

গত ৩০ আগস্ট জাতীয় পার্টির সম্মেলন আহ্বান করে চিঠি পাঠান দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। গত ১ সেপ্টেম্বর দলের ২৩ জনের সংসদ সদস্যের স্বাক্ষর নিয়ে রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে স্পিকারকে চিঠি দেন জি এম কাদের। তবে ওই চিঠির বিষয়ে সব সংসদ সদস্য একমত ছিল না বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ করায় দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মসিউর রহমান রাঙ্গাকে।

এ বহিষ্কারের পর নতুন করে আলোচনায় আসে জাতীয় পার্টির গৃহবিবাদ। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো বলছে, মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ কিছু নেতা রওশন এরশাদকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে চান।

দলের বেশির ভাগ নেতা জি এম কাদেরের সিদ্ধান্তে একমত বলে সূত্র জানিয়েছে। তারা বলছেন, সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে চালাতে হবে। রওশন এরশাদ যে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেছেন তাতে জাতীয় পার্টির সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আছেন। এদের কেউ কেউ ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি। তারাই রওশন এরশাদের ওপর ভর করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন বলে দলীয় সূত্রের অভিযোগ।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আলমগীর সিকদার লোটন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি একটা নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করতে চাচ্ছে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে। উনি এককভাবে দলটাকে সংগঠিত করতে চাচ্ছেন। চেয়ারম্যানের লক্ষ্য একক নির্বাচনের দিকে। যদি কোনো জোট হয় সেটা নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।’

তিনি বলেন, কারও ইন্ধনে বা তৃতীয় পক্ষ জড়িত আছে। সুবিধাবাদী একটা গোষ্ঠী তো সব দলেই থাকে। আমাদের দলে সুবিধাবাদীদের সংখ্যাটা একটু বেশি। আমাদের নিজস্ব পরিচয় আছে। যদি আমাদেরকে দালাল বলে তা হলে জাতীয় পার্টি করে লাভ কী? তা হলে আওয়ামী লীগই করি।

অব্যাহতির প্রত্যাহার চান রাঙ্গা, চুন্নু বললেন এখতিয়ার চেয়ারম্যানের

দলের সব পদ থেকে নিজের অব্যাহতির আদেশে অখুশি নন জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। তবে কাউকে পার্টিতে ফেরানোর এখতিয়ার শুধু জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

পৃথক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেন দলটির দুই নেতা। গত বুধবার মসিউর রহমান রাঙ্গাকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেন দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গার কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের রংপুরে কীভাবে রাজনীতি করে সেটা দেখে নেয়ার হুমকি প্রসঙ্গে। রাঙ্গা বলেন, অব্যাহতির আদেশ পাওয়ার পরে আমি একটু রাগান্বিত ছিলাম। এটা অস্বীকার করব না। আমি চেয়ারম্যানকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, সেটা তুলে নিয়েছি। রংপুরেও আর কোনো ঝামেলা হবে না। সেটা গতকাল (বুধবার) রাতেই বলে দিয়েছি।

তিনি বলেন, আমি কোনো অন্যায় করিনি। এটা বলার জন্য আজকে এই সংবাদ সম্মেলনে ডেকেছি। আমি আমার বহিষ্কারাদেশে অখুশি নই। আমি চাই দলটা যেন সুন্দরভাবে চলে। না ভেঙে যায়। দলটাকে ছোট করা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আমি নিজেই দলে থাকব না।

কেন আপনাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাঙ্গা বলেন, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে করার বিষয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে তার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। এটা আমি একটা টেলিভিশনকে বলেছিলাম, এই জন্য আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে করছি।

আগামীতে জাতীয় পার্টির রাজনীতি না করতে পারলে অন্য কোনো দলে যাবেন না বলেও দাবি করেন তিনি। রাঙ্গা বলেন, আগামীতে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকবে। আগামীতে শুধু দুটি রাজনৈতিক দল থাকবে। কোন দুটি থাকবে, সেটা আমি বলব না। তবে সেখানে আমরা (জাতীয় পার্টি) থাকব না।

এ দিকে বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্যই মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গেল এক বছর ধরে গণমাধ্যম, সংসদ ও বিভিন্ন ফোরামে মসিউর রহমান রাঙ্গা সংগঠনের নীতি ও অবস্থানবিরোধী কথা বলছিলেন। গেল এক মাস আগেও এমন একটি অবস্থার প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। তখন সংগঠনবিরোধী কোনো কাজ করবেন না বলেও অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। তবে মসিউর রহমান রাঙ্গার প্রতি পার্টির সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্র ও বিধি মোতাবেক হয়েছে।

তিনি বলেন, যদি জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান চান তবেই মসিউর রহমান রাঙ্গা জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন। কারণ, কাউকে পার্টিতে ফেরানোর এখতিয়ার শুধু জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের। এ সময় তিনি বলেন, কেউ দল থেকে চলে যেতে পারে তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয় না।

তিনি বলেন, এখন গঠনতন্ত্রের বিশ ধারার সমালোচনা করছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা, কিন্তু যখন মহাসচিব ছিলেন তখন তো এই ধারার কথা কখনোই বলেননি তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *