যুদ্ধ চায় মিয়ানমার

সীমান্তের আট কিলোমিটারের মধ্যে সেনাবাহিনীর যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হলেও তা না মেনে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে মাইন পুঁতে রেখেছে। বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমায় ঢুকে গুলি করেছে। মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল এসে বাংলাদেশে পড়েছে এবং তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার মিয়ামারের মর্টারশেলের আঘাতে শূন্যরেখায় একজন মারা যান। শনিবারও দফায় দফায় সীমান্তে বিকট গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন স্থানীয়রা। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা।

ধারাবাহিক এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, মিয়ানমারের এমন কর্মকাণ্ড উসকানিমূলক কি না। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মনে করেন, এটা তাদের ভুল। অবশ্য মিয়ানমার পাল্টা চিঠি দিয়ে ভুল স্বীকার করা দূরে থাক, বরং সম্প্রতি বাংলাদেশকে জানিয়েছে, সীমান্তে এমন কিছু ঘটেইনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের এসব কর্মকাণ্ড ভুল বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারা মনে করেন, মিয়ানমার চায়, বাংলাদেশ তাদের উসকানির ফাঁদে পা দিক।

এ প্রেক্ষাপটে তাদের মত হচ্ছে, কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের উচিত সীমান্তে শক্তি বাড়ানো। মিয়ানমারকে বাংলাদেশের শক্তির জানান না দিলে তারা এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন খোরাক জোগাবে। একই সঙ্গে সীমান্তে মিয়ানমারের এই আচরণ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেয়া উচিত বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা।

যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে বিষয়টি জাতিসংঘে তুলে ধরা হবে।

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি তারা তাদের ভেতরে যে কনফ্লিক্ট (সংঘর্ষ), সেটা তাদের ভেতরেই থাকতে হবে। আমাদের দিকে যাতে না আসে, সে জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও স্ট্রংলি বিষয়টি উত্থাপন করবে।’

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লুইস গুয়েন। গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিয়ত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে, মিয়ানমারের মিশনের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সত্যি বলতে পুরো ঘটনা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। যদিও ঘটনাস্থলে দেখার অনুমতি নেই। তাই উভয় দেশকে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ করেন লুইস গুয়েন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নিজ দেশের ভেতরে বিব্রতকর অবস্থায় আছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। আন্তর্জাতিকভাবেও অনেকটা কোণঠাসা। তবে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভারত-চীনের মতো দেশ মিয়ানমারকে সহায়তা করছে। আর ভারত-চীনের বিপরীতে মার্কিন বলয় সেখানে ক্রিয়াশীল।

নানামুখী চাপে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বাংলাদেশকে উসকানি দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটা উসকানি নয়, দুর্ঘটনা। তবে সবাই একটি বিষয়ে একমত, তা হলো মিয়ানামরকে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে তারা উসকানি দিতে চায়, যাতে আমরাও সামরিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি।’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাতে মিয়ানমারেরই লাভ। তারা এ ইস্যুটি ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ আটকে দিতে পারবে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার বিচার চলছে। অন্যদিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার জোরালো বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে সরকারের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের বেলায় মিয়ানমারের দুঃখ নেই

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা কিংবা সীমানায় ঢুকে পড়া মিয়ানমারের জন্য নতুন নয়। কিন্তু সেসব ঘটনায় জোর প্রতিবাদের মুখে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেনি।

২০১৫ সালে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান চীন সীমান্তে ঢুকে গোলবর্ষণ করলে চার কৃষক মারা যান। মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের তীব্র প্রতিবাদের মুখে মিয়ানমার দুঃখ প্রকাশ করে।

কারেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে থাইল্যান্ডের আকাশসীমাও বেশ কয়েকবার লঙ্ঘন করে মিয়ানমার। সবশেষ গত ৩০ জুন থাইল্যান্ডের আকাশসীমায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ ঢুকে পড়ে। প্রতিবারই থাইল্যান্ড জোর প্রতিবাদ জানায় এবং মিয়ানমার দুঃখ প্রকাশ করে।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর সীমান্ত অতিক্রম করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ঠাঁই হয় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

অথচ ২০১৭ সালের পর থেকে মিয়ানমার বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলেও একবারের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেনি। একই বছর বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে দুবার মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার আলীকদম সীমান্তে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের অন্তত দুই কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রতিবারই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়।

গত এক মাসে কয়েকটি ঘটনার পর বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমার নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। প্রথমে ২০ আগস্ট, এরপর ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে মর্টারের গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের সীমানায়। প্রতিবারই দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। দেয়া হয় কূটনৈতিক পত্রও। গত ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি হেলিকপ্টার থেকে বান্দরবানে বাংলাদেশের সীমানায় গোলাবর্ষণ করা হয়। তারপর আবারও রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ভুলবশত বাংলাদেশ সীমানায় তাদের গুলি এসে পড়েছে। এর পেছনে তাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই বা তারা উসকানি দিচ্ছে না বলেও গত ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান।

কিন্তু গত শুক্রবার বড় দুটি ঘটনার পর মন্ত্রীর এই বক্তব্যের ওপর বিশেষজ্ঞরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ ওই দিন নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টারশেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন, আহত হন পাঁচজন। এ ছাড়া তুমব্রু সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে অথোয়াইং তংচঙ্গ্যা নামে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে গুলি, মর্টারশেল, হেলিকপ্টার আসা অব্যাহত থাকলে আমাদের জন্য হুমকির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তা ছাড়া আমরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতেই রয়েছি, যা চলতে দেয়া যায় না।’

আরেকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান মনে করেন, ‘প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিকভাবে দেখানো উচিত। তাতে কাজ না হলে আমাদের সীমায় প্রবেশ করা দুই একটা হেলিকপ্টার গুলি করে ফেলে দেয়া উচিত। আমাদের মনে রাখতে, মিয়ানমার কিন্তু শক্তের ভক্ত নরমের যম।’

তুমব্রু সীমান্তে ফের গোলার শব্দ, আতঙ্ক

তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টারশেলের আঘাতে গত শুক্রবার এক রোহিঙ্গা যুবক মারা যাওয়ার পর শনিবারও দফায় দফায় বিকট গোলার শব্দ শোনা গেছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নিরাপত্তার কারণে গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় ৩৫টি পরিবার আশ্রয় নেয়ার গুঞ্জন উঠলেও তা নিশ্চিত করতে পারেননি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তবে ঘটনার পর থেকে সীমান্ত এলাকায় চলাফেরায় কঠোর নজরদারি শুরু করেছে বিজিবি।

গতকাল দুপুরে এসব তথ্য জানিয়ে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলম জানান, গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ হয়েছে।

গতকাল বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি দৈনিক বাংলাকে বলেন, সরকার কঠোর অবস্থানে আছে এবং জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরত্ব দিচ্ছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা প্রথমত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অ্যালার্ট করেছি তারা যেন জনগণকে নিরাপদে থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়।’

উল্লেখ্য, গত ১৩ আগস্ট থেকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধ চলছে, যা থামার লক্ষণ নেই।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন দৈনিক বাংলার প্রতিবেদক শাহরিয়ার হাসান, বান্দরবান প্রতিনিধি এস বাসু দাশ এবং কক্সবাজার প্রতিনিধি মুহিববুল্লাহ মুহিব]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *