রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি সময়ের বিবর্তনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আগের মতো শক্তিমান নয়। তবে একটা কথা আছে, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা।’ জাতীয় পার্টি এখনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দল। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় আসীন। অনেকের ধারণা, মহান সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদার চাপ ও সম্মানকে কেন্দ্র করেই মূলত জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব শুরু। নেতৃত্ব কার কাছে থাকবে? জাতীয় পার্টিতে এই লড়াইটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ
জাতীয় পার্টিতে কি হচ্ছে? দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টিই এখন আলোচনার বিষয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি সময়ের বিবর্তনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আগের মতো শক্তিমান নয়। তবে একটা কথা আছে, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা।’ জাতীয় পার্টি এখনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দল। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় আসীন।
অনেকের ধারণা, মহান সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদার চাপ ও সম্মানকে কেন্দ্র করেই মূলত জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব শুরু। নেতৃত্ব কার কাছে থাকবে? জাতীয় পার্টিতে এই লড়াইটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। ডাইনেস্টি বলে একটি কথা আছে, পরিবারতন্ত্র। এ কথা সত্য, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলে পরিবারতন্ত্রই মুখ্য। আর তাই কর্তৃত্ব শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পার্টিতে কর্তৃত্ব শব্দটাই চোখ রাঙ্গাচ্ছে। কর্তৃত্বের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ নামে আরেকটি শব্দ জাতীয় পার্টিতে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অবজ্ঞা এর অসম্মানের কানমন্ত্র দিতে শুরু করায় জাতীয় পার্টির বৃহৎ পরিবার কার্যত এখন অবিশ্বাসের কারাগারে বন্দি। গতকাল ছিল যে বন্ধু, আত্মার আত্মা। আজ সেই শত্রু। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। এই আগুনে ঘিরে রয়েছে মূলতঃ তৃতীয় পক্ষ। জাতীয় পার্টিতে এখন দুটি পক্ষ দৃশ্যমান।
একটি পক্ষ জাতীয় পার্টির সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী পক্ষ। অন্যটি ভাই পক্ষ। বিশেষ করে রওশন এরশাদপন্থি গ্রুপের নেতা সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গার বহিষ্কারের ঘটনার প্রেক্ষিতে দুইপক্ষের বিবাদ এখন স্পষ্ট। উভয় পক্ষ পরস্পরকে দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। গত শুক্রবার দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম করেছে ‘জাপায় উত্তেজনা, রংপুরের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ’। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে ‘মসিউরকে অব্যাহতি দিয়ে কঠোর বার্তা জাতীয় পার্টির’। দৈনিক জনকণ্ঠ শিরোনাম করেছে ‘জাপার কাণ্ডারি কে রওশন না জিএম কাদের? জাতীয় পার্টিতে উত্তাপ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, রাঙ্গার কার্যকলাপে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে তাই তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন এভাবে চললে দেশে জাতীয় পার্টি বলতে কিছু থাকবে না। জাতীয় পার্টির বিবাদ সম্পর্কিত এই রিপোর্টগুলো নির্দিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশ হয় ১৬ই সেপ্টেম্বর। ১৫ই সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত বিশেষ রিপোর্টে জাপা’র চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও বহিষ্কারের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত। মসিউর রহমান রাঙ্গার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় স্পিকারকে চিঠির বিষয়ে অনেকের আপত্তি ছিল পারলে বহিষ্কার করুক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরই মূলতঃ দলের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অভ্যন্তরীণ লড়াই শুরু হয়। এরশাদের জীবদ্দশায় তার দুই স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ ও বিদিশার মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিল। একে অপরকে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। এরশাদের মৃত্যুর পর তার দুই স্ত্রীর মধ্যে এখন মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। তাদের দুই সন্তান সাদ এবং এরিকও ‘ভাই’ বলতে অজ্ঞান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মূলতঃ দুই স্ত্রী ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দল যখন ঐক্যবদ্ধ থাকে তখন নেতাকর্মীরাও ঐক্যবদ্ধ থাকে। কোনো কারণে দলে যদি নেতৃত্ব পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তখন দলের নেতাকর্মীরাও বিশৃঙ্খলার অংশ হয়ে ওঠে। আগের দিন হয়তো একসঙ্গে মিছিল করেছিল, নেতার নামে স্লোগান দিয়েছিল, পরের দিনই তারা হয়ে যায় পরস্পরের শত্রু। রংপুর মূলতঃ জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। আর তাই পার্টির বর্তমান সংকটের আঁচটা বেশি পড়েছে রংপুর অঞ্চলে। সেজন্যই খবরের শিরোনাম হয়েছে ‘জাপায় উত্তেজনা রংপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ।’ এই সুযোগে অন্য একটা পক্ষ শত্রুতার আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে। জাতীয় পার্টির বর্তমান সংকটের সূত্রপাত মূলতঃ জাতীয় সংসদের স্পিকারকে দেয়া একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে। রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করতে জাপার পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে এই চিঠি দেয়া হয়। ফলে ক্ষুব্ধ হন রওশন এরশাদ ও তার পক্ষের নেতাকর্মীরা।
৩০শে আগস্ট রওশন এরশাদের নামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পৌঁছায়। তিন পৃষ্ঠার ওই বিজ্ঞপ্তিতে জাপা’র অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে বর্ণনার পর বলা হয় আগামী ২৬শে নভেম্বর দলের সম্মেলন হবে। চিঠিতে রওশন এরশাদ নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। একই সম্মেলন করার জন্য আট সদস্যের একটি কমিটির ঘোষণা দেন। রওশন এরশাদের এই আকস্মিক ঘোষণায় জাপা’র শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ৩০শে আগস্ট সন্ধ্যায় রওশন এরশাদের পক্ষে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিটি যখন প্রচারমাধ্যম সমূহে পৌঁছানো হয় তখন জাপা’র চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ দলের সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ছিলেন। সেখানেই বিষয়টি নিয়ে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। পরেরদিন রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন দলের সংসদ সদস্যবৃন্দ। মসিউর রহমান রাঙ্গাও দলের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সম্মতি দেন। অবশ্য পরের দিনই তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টি থেকে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে বহিষ্কার করা হয়।
রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। তাই বলে তিনি দলের চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে দলের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করবেন- এটা যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নয়। একইভাবে রওশন এরশাদ চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছেন কাজেই তাকে না জানিয়ে অর্থাৎ তার সম্মতি না নিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তও যুক্তিযুক্ত নয়। তবে এটা সত্য, উভয়পক্ষের বিপরীতমুখী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সুযোগসন্ধানী একটি পক্ষ সুচতুরভাবে ভূমিকা পালন করছে। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের কয়েকদিন আগে উত্তরাস্থ নিজস্ব বাসভবনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বেগম রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো পক্ষ একটা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। রওশন এরশাদ আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। আমাদের শ্রদ্ধার আসনেই আছেন এবং থাকবেন। তার নাম ব্যবহার করে পার্টির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করা হলে তা মেনে নেয়া হবে না। কথায় আছে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। জাতীয় পার্টির মতো এত বড় একটা রাজনৈতিক দল কি কথাটা জানে না? দ্বন্দ্ব কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।