অর্থনীতিতে হঠাৎ স্বস্তির বাতাস

দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ দিনে ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের আড়াই মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) ৫১৪ কোটি ২৮ লাখ (৫.১৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দর ১০৮ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই আড়াই মাসে ৪৫৪ কোটি ৪৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

ডলারের বিপরীতে টাকার বড় দরপতনে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা। আর এতে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্বস্তির বাতাস পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এখন কোনো প্রবাসী ১ ডলার দেশে পাঠালে তার পরিবারের যে সদস্যের নামে পাঠাচ্ছেন তিনি ১০৮ টাকা পাচ্ছেন। তার সঙ্গে আবার আড়াই শতাংশ সরকারের প্রণোদনাও পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে তিনি যে টাকা তুলতে পারছেন, তা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে যা পাওয়া যায়, তার সমান। সে কারণে প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। যার ফলে বাড়ছে এই সূচক; এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো।’

ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘তবে, যেহেতু প্রবাসীরা এখন বেশি টাকা পাচ্ছেন, আমার বিবেচনায় এখন আর আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেয়া উচিত নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ডলারের দর ১০৮ টাকার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। আগামী দিনগুলোতে এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। গত দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) মতো সেপ্টেম্বর মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসবে বলে আমরা আশা করছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার রেমিট্যান্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে (১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) ১০০ কোটি ৮৭ লাখ (১ বিলিয়নের বেশি) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ৮৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ। পরের মাস আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৭৮ (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ৪১৩ কোটি ৪১ লাখ (৪.১৩ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ-হতাশা এবং আগামী দিনগুলোতে কী হবে? এই প্রশ্ন সবার মধ্যে, তখন চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের (সরকার) সাহস জোগাচ্ছে। করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি। আগামী দিনগুলোতে কী হবে? এই দুশ্চিন্তা সবার মধ্যে, তখন স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ওই বছরে। আশা করছি, চলতি অর্থবছরে তার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাবেন আমাদের প্রবাসীরা।’

মহামারির মধ্যে ওই সময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন প্রবাসীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনীতিতে যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে, সেই সংকট কাটাতেও সবার আগে এগিয়ে এসেছেন প্রবাসীরা। আবার বেশি বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে রপ্তানিও বাড়ছে। আমদানি কমতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে একধরনের স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ডলারের বাজারের অস্থিরতাও কমে আসবে বলে মনে হচ্ছে। এতে অনেকটাই চাপমুক্ত হবে দেশ। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।’

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। শুরু থেকেই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ও তেমনই পূর্বাভাস দিয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরজুড়ে (২০২১-২২) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে নতুন অর্থবছরে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

এই অর্থবছরে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শ্রমিক নতুন করে বিদেশে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাওয়া যাবে।’ দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালচাল নিয়ে তৈরি করা পাক্ষিক প্রতিবেদনেও রেমিট্যান্স নিয়ে সুসংবাদের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

১৫ আগস্ট প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার ইতিমধ্যে রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সব প্রবাসী তাদের কর্মস্থলে ফিরেছেন। টাকার বিপরীতে ডলার বেশ খানিকটা শক্তিশালী হয়েছে। এই বিষয়টি আগামী মাসগুলোতে রেমিট্যান্স বাড়াতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে আশা করা হয়েছে, রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *