চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কা কি সফল হবে

নতুন কর্মসংস্থান এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা দুই দশক আগে চীনের উন্নয়ন মডেল গ্রহণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অবাস্তব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়েই শ্রীলঙ্কার সমাজের সামগ্রিক পতন হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটকে ব্যবহার করে একাধিক দেশ এখন এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। একদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের যে প্রভাব ছিল, দেশটি তা পুনরুদ্ধারে কাজ করছে। অপরদিকে চীন দেখতে পাচ্ছে, তার ফেলা কৌশলগত ও কূটনীতিক ফাঁদে সফলভাবে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কা।

দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ একসঙ্গে কাজ করেছে। সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশীদের ওপরও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোনোভাবে শ্রীলঙ্কাকে এই সংকট থেকে বের করে আনা যায় কিনা তা ভাবছে দেশগুলো।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশী ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। দেশটির ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ আছে এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। অথচ আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে দেশটি আমদানির ওপরে ব্যাপক মাত্রায় নির্ভর করে। জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের জন্য অন্য দেশের ওপরে নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কা।

গত কয়েক বছরে ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দেয়ায় শ্রীলঙ্কা সরকারের আয় ব্যাপক মাত্রায় কমে যায়। এরমধ্যে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনও। দেশটির অর্থনীতি পর্যটনের ওপরে ব্যাপক নির্ভরশীল হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সংকটে নিমজ্জিত হতে থাকে। সংকট সামাল দিতে দুই প্রতিন্দ্বন্দ্বী চীন ও ভারতের কাছে সাহায্য চায় শ্রীলঙ্কা।

গত দুই দশকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কয়েক গুণ হয়েছে দেশটির। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি বেশ ভালভাবেই চীনের ওপরে নির্ভর করতে শুরু করে। বর্তমানে চীনের কাছে ভয়াবহ মাত্রায় ঋণী শ্রীলঙ্কা। দেশটির হাতে মাত্র ১০ বছর সময় আছে, যার মধ্যে সুদসহ এই অর্থ ফেরত দিতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক নয়, শ্রীলঙ্কাকে কৌশলগত ফাঁদেও ফেলেছে চীন।

জাতিসংঘে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সমালোচনার হাত থেকে কলোম্বোকে রক্ষা করে চলেছে বেইজিং। এর অর্থ হচ্ছে, চীন শ্রীলঙ্কায় একটি কতৃত্ববাদী সরকারকে সমর্থন করছে। তাই শ্রীলঙ্কা এখন শুধু একটি ঋণের ফাঁদে পড়েছে তা নয়। এই সংকট চীনের কৌশলগত সুবিধা অর্জনের পথ হিসেবেও কাজ করছে।

শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে দারুণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দেশটির ওপরে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকায় এই সম্পর্ক দুর্বল হতে থাকে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় যে সংকট চলছে তার প্রভাব ভারতেও পড়তে পারে।

মূলত ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই শ্রীলঙ্কার সংকটকে হালকা করে দেখতে পারে না ভারত। এই সংকট থেকে যদি শ্রীলঙ্কায় সশস্ত্র বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় তা ভারতের জন্য বড় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হবে।

তাছাড়া, খাদ্য, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব থেকে শরনার্থী হতে পারে লাখ লাখ শ্রীলঙ্কান। তারা ভারতের তামিল নাড়ুতে আশ্রয় নেবে, এবং মানবিক কারণে ভারত সরকারও তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হবে। এতে চাপে পড়বে তামিলনাড়ুর অর্থনীতি। এছাড়া, শরনার্থী শিবিরগুলোও ভারতের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। শরণার্থী হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারে এলটিটিই সদস্যরাও।

গত দুই বছরে সংকট মোকাবেলায় ভারতের সঙ্গেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা। ভারতও একে নতুন করে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবে দেখছে।

শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে ভারত। এটি সাময়িক সময়ের জন্য দেশটির সংকট সহজ করবে। এই সংকটে শ্রীলঙ্কা চাইছে ভারত ও চীনের মধ্যে একটি সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরি করতে। দেশ দুটির যে ভূ-রাজনৈতিক আগ্রহ রয়েছে তাকেই কাজে লাগাতে চাইছে কলম্বো। কিন্তু চীন ও ভারতকে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলানো শ্রীলঙ্কার জন্য বিপজ্জনক।

কারণ, যত সাহায্যই আসুক না কেনো, নিকট ভবিষ্যতে দেশটির এই অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই। চীনের সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক চুক্তির পূর্বে শ্রীলঙ্কাকে অবশ্যই তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক খেলা বাদ দিয়ে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজের অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে শ্রীলঙ্কাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *