‘বড় ভাইদের’ মতামত ছাড়াই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি
বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি গঠনে বরাবরই সাবেক ছাত্রনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। গত কয়েকটি কমিটি গঠনে ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিলেন তাঁরা, কিন্তু এবারের কমিটি গঠনের সময় সাবেক ছাত্রনেতা ‘বড় ভাইদের’ মতামত নেওয়া হয়নি।
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলে সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচন করা হয়, কিন্তু এবার কাউন্সিল করা হয়নি। গত ১২ এপ্রিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন কমিটি গঠন করা হবে বলে ছাত্রদল নেতাদের জানান।
এর পাঁচ দিন পর ১৭ এপ্রিল নতুন কমিটি পেল ছাত্রদল। কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কিছু আঁচ করতে পারার আগেই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। যার কারণে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে দলাদলির সুযোগও ছিল না।
সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জানান, এবারই প্রথম ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর প্রকাশ্যে কোনো বিদ্রোহ হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের পর যত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সব কটির বিরোধিতায় প্রকাশ্যে বিদ্রোহ হয়েছিল।
কেন এবার কাউন্সিল বা ভোট হয়নি—জানতে চাইলে সাবেক এক ছাত্রনেতা বলেন, যাঁরা নেতৃত্বে থাকেন তাঁরা সারা দেশে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নিজ পছন্দের ব্যক্তিকে নেতা মনোনীত করেন। পরের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে নেতা নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে।
ছাত্রদল নেতাকর্মীরা বলছেন, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ‘বড় ভাই’দের গ্রুপিং-লবিং এবার দেখা যায়নি। নেতা হতে তাঁদের কাছে ধরনা দেওয়ার সুযোগও পাওয়া যায়নি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেই কমিটি গঠনের দায়িত্ব নিয়েছে। আগামী কয়েকটি কমিটি গঠনে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে সাবেক ছাত্রনেতাদের ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে যাবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
নতুন কমিটির একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক। গত কয়েকটি কমিটির নেতারা তাঁর সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন। যার কারণে নেতা মনোনীত করতে তাঁকে অন্য কারো সহযোগিতা নিতে হয়নি।
ছাত্রদলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, হাবিব- উন-নবী খান সোহেল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, হাবিবুর রশীদ হাবিব, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, রাজীব আহসান, আকরামুল হাসানসহ আরো কয়েকজন ভূমিকা রাখতেন। তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিরা কমিটিতে স্থানও পেতেন।
তবে সুলতান সালাউদ্দিন টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র মোতাবেক ছাত্রদলের কমিটি হয়ে আসছে। আমরা কেউ কাউকে নেতা বানিয়েছি—এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আগের মতো এবারও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যোগ্য নেতৃত্বকে মনোনীত করেছেন। তিনি ছাত্রদল নেতাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্পর্কে জানেন। এই কমিটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। ’
কেমন কমিটি হয়েছে—জানতে চাইলে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের এক যুগ্ম সম্পাদক বলেন, যোগ্যরা নেতৃত্বে এসেছেন, এতে সন্দেহ নেই। তবে বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে যোগ্য নেতা থাকলেও গত কয়েকটি কমিটিতে তাঁরা স্থান পাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, আগের কেন্দ্রীয় কমিটি সারা দেশে যেসব ইউনিট কমিটি করেছিল সেখানে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম হয়েছে। এখন সবাইকে সমন্বয় করে নতুন কমিটি কিভাবে এগোবে, সেটা দেখার বিষয়।
ছাত্রদলের নতুন সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ আগের কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। ২০১৮ সালের সভাপতি পদে নির্বাচনে মাত্র আট ভোটে হেরে যান তিনি। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাঁর বিরোধিতা করেছিল দলের একটি অংশ। ভোটে পরাজিত হওয়ার পেছনে তাঁর প্রতিপক্ষরা এ বিষয়টি কাজের লাগিয়েছিল তখন। সেই শ্রাবণকে এবার কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে।
শ্রাবণের বাড়ি যশোরের কেশবপুরে। তাঁর বাবা কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলাম। রফিকুল ইসলামের বড় ছেলে কাজী মুস্তাফিজুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। মেজো ছেলে কাজী মুজাহিদুল ইসলাম পান্না উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। সেজো ছেলে কাজী আজাহারুল ইসলাম মানিক উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক।
জানতে চাইলে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক আদর্শের কারণে ১০ বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক আদর্শের কারণে পরিবারের কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। তাঁরা হয়তো ভাবেন, যোগাযোগ রাখলে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ছাত্রদলের নতুন সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের বাড়ি বরিশাল। গতবার সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তিনি ১০ শতাংশের কম ভোট পান। তাঁর বিরুদ্ধে সামাজিক অপরাধে মামলা থাকায় সাবেক ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত সার্চ কমিটি তাঁর মনোনয়ন বাতিল করেছিল। পরে হাওয়া ভবনসংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির তদবিরে মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়।
নতুন কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ আগের কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বাড়ি নরসিংদী। সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক। তিনি ময়মনসিংহের সন্তান। আর সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াহইয়া আগের কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বান্দরবান জেলায় তাঁর বাড়ি। দীর্ঘদিন পর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে নেতা এলো বলে জানান সংগঠনের কর্মীরা।
সংগঠনের সূত্র জানায়, নতুন সভাপতি শ্রাবণ ও যুগ্ম সম্পাদক রাকিব ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারী। সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক জুয়েল সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম নয়ন ও রাজীব আহসানের অনুসারী। আর সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াহইয়া সাবেক ছাত্রদল নেতা ফেরদৌস মুন্নার গ্রুপে রাজনীতি করতেন।
ছাত্রদল সভাপতি শ্রাবণ বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সংগঠনকে তৈরি করব। সব গ্রুপ ও মতের নেতাদের সমন্বয় করে সারা দেশে আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। ’
তিনি বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড, থানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি করে সংগঠনের সবাইকে সাংগঠনিক পরিচয় দেওয়ার কাজকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। পাশাপাশি ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি গতিশীল করবেন।